![]() |
শামিমা এহেসানা |
শিউলি বীজ
(গল্পের বিষয় - একটি ছাত্র, তার শিক্ষিকা , আর জীবন বদলে দেওয়া অনুপ্রেরণা)
আজ সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ। মৃদুল ছটফট করছে ভারতীয় সময়, সকাল সাতটা বাজার। রিটায়ারমেন্ট এর পর দিদিমনির শরীর ভালো থাকেনা। তাই সাতটার আগে ঘুম থেকে ওঠানো ঠিক হবেনা। মৃদুল এর কাছে মা, দিদি, আর নিজের জন্মদিন যতটা স্পেশাল। ততটাই স্পেশাল শিক্ষক দিবস। এই দিন মৃদুল পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক দিদিমনিকে ফোন করে প্রনাম জানাতে ভোলেনা।
আমেরিকার বৃষ্টি আর ভারতের বৃষ্টির মধ্যে ঠিক কতটা পার্থক্য সে কথায় ভাবছিল মৃদুল।
ঠিক পনেরোটা বছর আগে দিদিমনির বলা গল্পটার প্রতিটা শব্দ আজও মৃদুলের কানে বাজে।
যখন যখন হেরে যায় মৃদুল, ওই গল্পটাই ওর মেরুদন্ডটাকে শক্ত করে তোলে। আজও ভেংগে পড়ার আগে সামলে নেয় দিদিমনির বলা গল্প।
সেদিন চড়ম বৃষ্টি। বেশির ভাগ ছাত্র-ছাত্রী শেষ মুহুর্তে স্কুলের পোষাক পাল্টে মা এর কাছে খিচুড়ি বেগুন ভাজার আব্দার করেছে। মৃদুল পারেনি, কারন মা সকালেই বেরিয়ে গেছে। সন্ধ্যের আগে ফিরবেনা। দিদি, মাসির বাড়িতে ছুটি কাটাতে গেছে। তাই বৃষ্টি ভেজা স্কুল মৃদুলের কাছে সেদিন বেটার অপশন ছিলো।
আর সেদিন স্কুলে না গেলে জীবনটাও পালটানোর সুযোগ থাকতোনা তার কাছে।
মৃদুল লাস্ট বেঞ্চে বসে থরথর করে কাঁপছে। বৃষ্টিতে জামা প্যান্ট ভিজে তার গায়ে সেঁটেছে। ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাস নেবেন ভৌত বিজ্ঞান দিদিমনি। যেমন রাশভারী, তেমন সুন্দরী। ক্লাসে ঢুকেই মৃদুলকে এক ধমক। ভাগ্যিস বেশি জল খায়নি সকাল সকাল। নাহলে আজ ডবল বিপদ থাকতো ভাগ্যে।
দিদিমনির ধমকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেছে মৃদুল।
আজ প্রথম দিদিমনির কাওকে বকা দিয়ে এত খারাপ লেগেছে। মৃদুলকে বসতে বলে, দিদিমনি নির্দেশ দিলেন তাকে, আজ টিফিনের ঘন্টা পড়লে আমার সাথে দেখা করবি।
মৃদুল ভয়ে কাঠ। কি জানি তার কপালে আজ কি লেখা আছে, ভেবে গলা শুকিয়ে আসে মৃদুলের।
শেষ পর্যন্ত টিফিনের ঘন্টা। জামাটা অনেকটা শুকিয়েছে ফ্যানের হাওয়ায়। কিন্তু প্যান্টটা তখনও ভিজে। স্টাফ রুমে ঢুকতেই মৃদুলকে একটা ছোট্টো টুল দিয়ে দিদিমনি বসতে বললেন।
সেদিন অত বৃষ্টিতে মৃদুলের স্কুলে আসার কারন শুনেও দিদিমনি রাগ করেননি।
মৃদুলের ভাংগা কোম্পানীর বিজ্ঞাপনি ছাতাটা দেখে ক্লাসের ছেলে মেয়েরা তাকে কোম্পানির শুরুর দুটো শব্দ, মানে 'ভোডা' বলে ডাকে। আজ সকালে যখন মৃদুল স্কুলে ঢুকছিল, দিদিমনি তাকে দেখেছেন। আর ক্লাসের ছেলেমেয়ের ভোডা বলে খ্যাপানোটাও ম্যাডামের কানে পড়েছে।
দিদিমনি সেদিন মৃদুলকে ডেকে একটা গল্প শুনিয়েছিলেন।
আর তার পরের দিন একটা নতুন ছাতা এনে মৃদুলের হাতে দিয়েছিলেন। পরের দিন থেকে আর কেও তাকে ভোডা বলে ডাকেনি। কারন দিদিমনি পরের দিনই ক্লাসে এসে জানিয়েছিলেন, ভবিষ্যতে কেও মৃদুলকে ওই নামে ডাকলে তারা যেন গার্জেন কলের জন্য প্রস্তুত থাকে।
মৃদুলকে দিদিমনি যে গল্পটা বলেছিলেন, আজ সেটা আবারও মৃদুল মনে করে।
দিদিমনি বলেছিলেন,
শিউলি ফুলের বীজটিকে কাক, খাবার ভেবে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিল।
খানিকটা দূরে উড়ে গিয়ে কংক্রিটে মোড়া শহরের একটি দেওয়ালে বসে কাক বুঝতে পারে ওটা খাবার মত জিনিস নয়। রাগ করে সূচালো নখ দিয়ে টোকা মেরে বীজটাকে ছুড়ে ফেলে দিল কংক্রিটের মেঝেতে।
ওভাবেই সপ্তাহ খানেক পড়ে ছিল বীজটা। তারপর ওই রাস্তা দিয়েই একটা স্কুলের ছাত্র হাঁটছিল। তার ড্রেনের কাদা মাখা জুতোর নিচে আটকে পড়লো বীজটা। স্কুলের বাইরের মাঠে দৌড়ানোর সময়, বীজটা খুলে পড়ল ছাত্রের জুতো থেকে। পড়বি তো পড় পাথরের উপরেই পড়লো। না আছে জল, না আছে মাটির কোনো সম্ভাবনা।
বীজটা মনের শক্তি হারিয়ে ফেলছিল। ভাবলো আর সুযোগ নেয় তার জীবন পেয়ে গাছ হয়ে ওঠার।
মনে মনে বীজ তার মা, মানে গাছের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল তার দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির জন্য, তার অক্ষমতার জন্য।
তারপর মাস খানেক পর বিনা মেঘে, বিনা মরশুমে, শিয়াল মামার বিয়ের দিনের মত করে বৃষ্টি এল। একটু বেশি ঝমঝম শব্দ করেই এল বৃষ্টিটা। জলের ঝাপটায় একটু একটু করে সরে গিয়ে মাটি ছুঁলো বীজ। তারপর বৃষ্ঠির মরশুম আসতেই দূর্ভাগা সুপ্ত বীজ চারা গাছ হয়ে উঠলো।
বছর দশ এক পর,
এখন সে ফুল ফোটা শিউলি গাছ। গোটা সন্ধ্যা শিউলি ফুলের গন্ধে ম ম করে বাতাস।
সকালে ঠাকুর ভক্তেরা আসে গাছে লেগে থাকা কয়েকটা ফুল সংগ্রহ করার ইচ্ছায়। আর, পাড়ার কচি-কাঁচা বলাই রা আসে গাছের নিচে পড়ে থাকা ফুল কোড়ানোর লোভে।
এতটুকুই বদলে ফেলেছিল মৃদুলকে। সংসারের অভাব, বাবার মৃত্যু, অসহায়তা, সব কিছু দিনের পর দিন গ্রাস করেছে মৃদুলকে। কিন্তু ওই দিনটার পর সে আর পিছন ফিরে দেখেনি। স্কুল ছাড়ার পরও দিদিমনি বিভিন্নভাবে মৃদুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এখন মৃদুল আমেরিকায় ইঞ্জিনিয়ার।
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন