রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নভঙ্গ : মৃদুল শ্রীমানী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নভঙ্গ : মৃদুল শ্রীমানী
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নভঙ্গ  
 
মৃদুল শ্রীমানী

স্বপ্নভঙ্গ তাঁর  ঘটে গিয়েছিল যৌবন অতিক্রান্ত হবার আগেই। রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, তাঁর নিজের দেশের লোকগুলো নিজেরা এক একটা গোটা মানুষ নয়। রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করো নি, মুগ্ধ বঙ্গজননীর প্রতি এই ধিক্কার বাক‍্য তাঁর ছিল। আমেরিকার পুঁজি সন্ত্রাসকেও তিনি ভাল ভাবে চিনেছিলেন। এ নিয়ে সৌমেন ঠাকুরকে চিঠিতে অনেক কিছু লিখেছেন। নিজের দেশের চাষি ঘরের ছেলে একটু লেখাপড়া শিখে কি করে দুর্বলতর চাষিকে শোষণ করতে অভ‍্যস্ত হয়ে যায় সেটাও দেখেন। দেশের লোক সমবায় বলতে শুধু টিপে টিপে লোন দিতে শিখলো, এইটাই একমাত্র ধ‍্যান জ্ঞান, আর ছোটো রায়ত স্বপ্ন দ‍্যাখে সে গোটাকতক আরো ছোট রায়তকে গিলে বড় রায়ত হয়ে উঠবে। 
 
বিশ্বভারতী তিনি যে কার হাতে দিয়ে যাবেন ভেবে পেতেন না। বিশ্বভারতী কে কেউ কেউ ব‍্যঙ্গ করে বলতেন "বিশ্ব বা রথী"। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র ছিলেন এ যেমন সত‍্য, তেমনি সত‍্য, বিশ্বভারতীর ছাত্রদের মধ‍্য থেকে তেমন মজবুত মানুষ উঠে আসছিলেন না। এই শূন‍্যতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গভীর উদ্বেগের কারণ ছিল। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন চ‌ওড়া কাঁধের মানুষ। তাঁকে পেতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সুভাষের ইচ্ছে ছিল অন‍্য রকম। লেনার্ড এলমহার্স্ট শ্রীনিকেতনের গোড়াপত্তন করে দিয়ে গেলেন। কিন্তু কবির অবর্তমানে বিশ্বভারতীর কি হবে ভেবে উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ গান্ধিজীর হাত ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ছিলেন। বাঁশি তোমার দিয়ে যাব কাহার হাতে। চারপাশে গোটা মানুষের অভাব অনুভব করতেন তীব্র ভাবে। তাই বিদ‍্যাসাগর মশায়কে স্মরণের ছলে লিখেছিলেন, তিনি বঙ্গদেশে একক ছিলেন। গভীর হতাশা নিয়ে বলতেন এই বাংলায় আমাকে যেভাবে অপমান করা যায়, এমনি আর কাউকে নয়। সমস্ত প্রচেষ্টা বাঙালির ছোটোমির কাছে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখে তাঁর মনে হত, সমস্তই বুঝি এক আশ্চর্য ছলনাময়ীর কাণ্ড!
 
কবির লক্ষ্য ছিল সত‍্যে পৌঁছনো। আমাদের বাংলাকে মানুষ করবেন বলে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন বিশ্বভারতীতে বিশ্বকে একটি নীড়ে মেলাতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যে ঠিক কি চাইতেন, সে তাঁর তৈরি করা প্রশ্নপত্র খুঁটিয়ে দেখলে আন্দাজ করা যায়। প্রতি মুহূর্তে বাঙালির অক্ষমতা আর চিন্তা করার দৈন‍্য তাঁর চোখে পড়ত। বিশ্বভারতীর নানা কাজে নিজের চারপাশে থাকা মানুষগুলির কর্মোদ‍্যোগের সীমাবদ্ধতা তাঁর চোখে পড়ত। শুধুমাত্র বিশ্বভারতীই নয়, দেশে স্বাধীনতার নাম করে ঠিক কি যে উদ্ভট একটা পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে, তা তাঁকে প্রবীণ বয়সে উদ্বিগ্ন রাখত। বাঙালি ভদ্রলোকের নির্লজ্জ সুবিধাবাদ আর স্বার্থপরতা ভদ্রসমাজের একজন হিসেবে তাঁকে ক্ষুব্ধ করত। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর, বিশ্বভারতীর প্রাঙ্গণে ভদ্রলোক বাঙালি সমাজ যখন কবিকে সংবর্ধনা জানাতে গিয়েছিলেন, তার প্রত‍্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, গড় বাঙালি তাকে সাজানো গোছানো ভদ্র আচরণ বলে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মনের কথাটি বলতে দ্বিধা করেন নি। জালিয়ান‌ওয়ালাবাগের কাণ্ডেও তাই। আগুনখেকো পলিটিশ‍্যানরা যখন শাসকের দাঁত নখ মুখব‍্যাদান দেখে গর্তে সেঁধিয়েছেন, কারো মুখে কথাটি সরে না, তখন ব্রিটিশদের দেওয়া সম্মান ফিরিয়ে দেবার উদ‍্যোগ নিতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। হিসেবি লোক হলে ঠিক ভাবতেন ব‌ইয়ের বিক্রি কমে যাবে কি না, বক্তৃতা করে যে দক্ষিণা মেলার কথা, তাতে কোপ পড়বে কি না। অর্থাৎ সাধারণ ভদ্রলোকের দল, যে সব প‍্যারামিটার দেখে ডিশিসন মেকিং করেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হিসেব ছিল তার উলটোমুখে। ভাল মানুষ ন‌ই রে মোরা, ভাল মানুষ ন‌ই, এই কথাটা তাঁর জীবনসত‍্য। সোভিয়েত বিপ্লবীদের কিছু কাজকে তিনি কড়া সমালোচনা করেছিলেন, এই কথাটা কিছু লোকে অট্টরবে বলে শান্তি পায়। কিন্তু, তিনি যে সোভিয়েত ব‍্যবস্থায় অতি সাধারণের মধ‍্যে অতি দ্রুত হারে সার্থক শিক্ষা বিস্তারের কার্যকর উদ‍্যোগকে প্রাণভরে সমর্থন করেছিলেন, তার ভিতরকথাটি উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে বলতে এঁদের কার্পণ্য আমার চোখে লাগে। 
 
হাসির মতোই কান্নাও বহুরকম। সব কান্না তো চোখে দেখে মেপে ফেলা যায় না। যে মানুষ সারা জীবন ধরে আত্মনির্ভরশীল হবার কথা বললেন, তিনি যখন চারপাশে বিশ্বভারতীর দায়িত্ব পালনের চ‌ওড়া কাঁধ খুঁজে না পান,  একটা গোটা জীবনের সাধনা যখন নিষ্ফল হতে বসে, তখন হাউহাউ কান্না আসাটাই স্বাভাবিক। চোখ দিয়ে জল গড়ালো কি গড়ালো না,  গড়ালে কতটা পরিমাণ গড়ালো, এটা তত বড় ইস‍্যু নয়।
 
রবীন্দ্রনাথ সিরিয়াসলি চেয়েছিলেন তাঁর প্রয়াণ হোক তাঁর সাধনভূমিতে, শান্তিনিকেতনে, নিরালায়। যথার্থ বাউল তাই কাঙ্ক্ষা করে। সাবধান করে ছিলেন, তাঁর মৃত‍্যুর পর তাঁর নামে স্লোগান দিতে দিতে দেহাবশেষ বহন করা না হয়। তিনি অভিমান করে বলেছিলেন, সে আমারে কে চিনেছ? কিন্তু শান্তিনিকেতনের ম‍্যানেজার কুল কবির শেষ নির্দেশের একপয়সা দাম দেন নি। রথীন্দ্রনাথ তো ক্রাউড ম‍্যানেজমেন্ট বা ক্রাইসিস ম‍্যানেজমেন্ট, কোনোটাতেই দক্ষ ছিলেন না। তাই জোড়াসাঁকোর লোহার গেট ভেঙে উন্মত্ত জনতা কবির দেহাবশেষ লুঠ করে নিয়ে যাবে, এটা আগে থেকে ভেবে রেখে পর্যাপ্ত সাবধানতা তিনি নেবেন, এটা আশাতীত। এমনকি "অমানুষ" বাঙালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মরদেহ থেকে চুল ও দাড়ি উৎপাটন করে নিয়েছিল স‍্যুভেনির সংগ্রহ মানসে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অযোগ্য পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের দেহাবশেষের এই অসম্মান হয়েছে। নিজের বড়ছেলেকে ভাল‌ই জানতেন কবি। গোলাপবাগান সর্বসাধারণের উপভোগের স্বার্থে লাইব্রেরির সুমুখে হোক, কবি চেয়েছিলেন। রথী চান নি। এই নিয়ে বাপ ছেলেতে বিরোধ হয়েছিল। প্রচণ্ড গরমে ছাতে একটা টিনের ঘরে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন কবি, অভিমানে। 
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাগতে জানতেন, কাঁদতে জানতেন, প্রাণভরে ধিক্কার দিতেও জানতেন। তিনি সেই মাপের কবি ছিলেন না, যাকে প্রতি মুহূর্তে ব‍্যালান্স করে ঠেকনা দিয়ে সবদিক বাঁচিয়ে কথা বলতে হয়। তিনি নিজের জোরে সম্মান আদায় করেছিলেন। পলিটিক্যাল দলের তলপি বহে রত্নহার গলায় পরেন নি। তাঁর যা ছিল, তা তাঁর নিজের ছিল। উঞ্ছবৃত্তি করে পাওয়া জিনিস নয়। তাই তিনি নোবেল পুরস্কার এর টাকা এলে বলতে পারতেন, ওই তোমাদের নর্দমা গড়ার টাকা এসে গেছে। নোবেল পুরস্কার টি যারা সযত্নে রাখতে পারে না, দোষীকে খুঁজে বের করার পলিটিক্যাল উইলে যাদের ঘাটতি আছে, তারা রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান বাজাতে পারে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনুষ্যত্ব চর্চার থেকে তারা যোজনপ্রমাণ দূরে থাকেন।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.