শুনলাম। কী‌ হয়েছিল রে? : সিদ্ধার্থ সিংহ

সুচিত্রা ভট্রাচার্য

শুনলাম। কী‌ হয়েছিল রে?

সিদ্ধার্থ সিংহ
 

মঙ্গলবার অফ ডে।‌ ফলে বারোটা বাজার আগেই বিছানায় চলে গিয়েছিলাম। বিছানায় উঠতে না- উঠতেই ফোন। কে করেছে না দেখেই বালিশের তলায় মোবাইল গুঁজে দিয়েছিলাম।‌ দু'মিনিটও কাটল না। আবার ফোন বেজে উঠল। এত রাতে আমেরিকার গৌতম গ্যারি দত্ত ছাড়া আমাকে কেউ ফোন করে না। করছে মানে নিশ্চয়ই কোনও জরুরি দরকার। ফোনটা বের করে দেখি, নিখিলেশের নম্বর। আগের বারও কি ও-ই করেছিল! দেখি, না। নিবেদিতার ফোন। নিবেদিতা দে আমার সহকর্মী আর নিখিলেশ বিশ্বাস আমার ছোটবেলাকার বন্ধু। সুচিত্রাদির প্রথম উপন্যাস ও-ই প্রকাশ করেছিল। কিন্তু এই মধ্যরাতে দুই মেরুর দু'জনের পর পর ফোন দেখে একটু খটকা লাগল। কী হল রে বাবা! রিং ব্যাক করতেই নিখিলেশ বলল, কিছু খবর পেয়েছিস?
আমি বললাম, না।
ও বলল, খবরটা দ্যাখ তো।

কিন্তু আমি যে ঘরে থাকি, সে ঘরে কোনও টিভি নেই। পুরনো আমলের বাড়ি। আমার ঘরের চারটে ঘর বাদ দিয়ে বউয়ের ঘর। সেই ঘরে টিভি। মায়ের ঘরে আছে। কিন্তু এত রাতে ওদের ঘুমাব! ফোন করলাম এবিপি আনন্দে। প্রথমে সুমনকে। তার পর তীর্থকে। ওদের না পেয়ে সোমেনকে। কিন্তু কেউই ফোন ধরল না। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ফোন ধরতে না-পারলেও মিস কল দেখলেই ওরা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে। অগত্যা ওদের‌ ল্যান্ড নম্বরে ফোন করে যা শুনলাম, সেটা আমার কল্পনারও বাইরে।

পাশের ঘরেই থাকে আমার ছেলে শুভঙ্কর। মাত্র দু'দিন আগে হস্টেল থেকে বাড়ি এসেছে। নানা বিষয় নিয়ে চর্চা করে। গিটার বাজায়। ছবি আঁকে। সুচিত্রাদির কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদও করেছে। ওকে সুচিত্রাদির কথা বলতেও ও আকাশ থেকে পড়ল, সে কী গো!

তখন বারোটা দশ কি পনেরো। দু'জনে রওনা হয়ে গেলাম ঢাকুরিয়ার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে মনে পড়ে গেল--- এই তো সে দিন, যাঁকে আমরা 'পেরেক চক্রবর্তী' বলে ডাকতাম, সেই শম্ভুদা একদিনের আমাদের গল্পচক্রে নিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলাকে। এর মধ্যেই নাকি তিন-চারটে গল্প যুগান্তর পত্রিকায় লিখে ফেলেছেন তিনি।
রোববার-রোববার পালা করে গল্পচক্র বসত এর-ওর বাড়িতে। বেশির‌ ভাগ দিনই বসত এই গল্পচক্রের মূল উদ্যোক্তা রাধানাথ মণ্ডলের বাড়িতে। সে দিনও বসেছিল নাকতলার বান্টি সিনেমার গা দিয়ে খানিকটা ঢুকে রাধানাথদার বাড়িতে। যত দূর মনে পড়ছে, সে দিন সেখানে ছিলেন নবকুমার বসু,‌ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দত্ত, শিবতোষ ঘোষ, কানাই কুন্ডু, শ্যামল মজুমদার-সহ আরও দু'-একজন।
সে দিনই প্রথম আলাপ সুচিত্রার সঙ্গে। ওটা সম্ভবত উনিশশো বিরাশি কি তিরাশি সাল। আমি তখন ইলেভেন কি টুয়েলভে পড়ি। সেই শুরু। তখন থেকেই উনি আমাকে স্নেহ করতেন।
কত দিন হয়েছে রবিবারের সকাল গল্প করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেছে। সুচিত্রাদির বাড়িতে খেয়েদেয়ে, দুপুরে ঘুমিয়ে ওখান থেকেই সোজা অফিসে চলে গেছি। ওটা ছিল আমার আর একটা বাড়ি।
সপরিবার কোথাও বেড়াতে যাওয়ার আগে কুণালদা, প্রদীপদা আর সুচিত্রাদি মিলে আমার যাতে কোনও অসুবিধা না-হয়, সে‌ জন্য সেই জায়গাটা সম্পর্কে খুঁটিনাটি সব বলে দিতেন। গত বার যখন বাড়ি থেকে ঠিক করে গেলাম, এ বার জঙ্গলে যাব। তখন ওদের পরামর্শেই জঙ্গল বাতিল করে সিমলা-কুলু-মানালি-অমৃতসর করে ফেললাম। শুধু তা-ই নয়, শিবকালী এক্সপ্রেসে না গেলে যে পুরো ট্রিপটাই বৃথা, সেটা ওঁরাই প্রথম বলেছিলেন। পাশের ঘর থেকে কুণালদা এনে দিয়েছিলেন সুচিত্রাদির লেখা 'কুড়িয়ে পাওয়া পেনড্রাইভ' বইটি।‌ সুচিত্রা বলেছিলেন, যাওয়ার আগে এটাএকটু পড়ে নিস।
মনে পড়ে গেল--- ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য আমি একবার একটু আর্থিক সংকটে পড়েছিলাম। তাই আমার অত্যন্ত কাছের একজন, এখানে আমি তাঁর নাম বলতে চাইছি না। যিনি সে বারই একটি উপন্যাসের জন্য এক কোটি টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁকে বলেছিলাম, আমি চার লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক‌ লোন নিতে চাই। আপনি যদি একটু গ্যারান্টার হন...
তিনি বলেছিলেন, আমার তো বয়স হয়েছে, কখন কী হয় বলা যায় না। পরে কোনও সমস্যা হলে আমার বউ বিপদে পড়বে...
এ কথা জানতে পেরেই সুচিত্রাদি বলেছিলেন, তুই আমাকে বলিসনি কেন? তোর কোনও চিন্তা নেই। আমি তোর গ্যারান্টার হব।
আমি চমকে উঠেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, রাধানাথদার প্রকাশনা সংস্থা 'সংবাদ'-এর জন্য গ্যারান্টার হয়ে সুচিত্রাদি কী বিপদেই না পড়েছিলেন। তার পরেও...
না। সে যাত্রায় আমার আর ব্যাঙ্ক লোনের দরকার হয়নি। আমি লোনের জন্য চেষ্টা করছি লোক-মুখে শুনে চার লক্ষ‌ নয়, আমার মা‌ আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে একটা পলিপ্যাকে করে চুপিচুপি ন'লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছিলেন।
ছেলের যখন পৈতে হল, তখন তার কী মেনু হবে, শুধু তা-ই নয়, অতিথিদের কোন ঠান্ডা পানীয়ের সঙ্গে দক্ষিণাপনের কোন দোকানের জলজিরার সরবত দিলে ভাল হয়, সেটাও ঠিক করে দিয়েছিলেন সুচিত্রাদি।
সুচিত্রাদি আর আমার যৌথ সম্পাদিত অনেকগুলো সংকলন আছে। শেষ যে সংকলনটি বেরিয়েছে, সেটার লেখক-সূচী নিয়ে সুচিত্রাদি আমার উপরে একটু উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তাই আমিও কয়েক সপ্তাহ যাইনি। ফোনও করিনি।
হঠাৎ একদিন সক্কালবেলায়‌ সুচিত্রাদির ফোন। দরকারের চেয়ে ‌অদরকারেই ফোন করতেন বেশি। ক'দিন আগে বলেছিলেন, তোকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। একসেপ্ট করে নিস‌ তো... তোর ফেসবুকে ক'টা ছবি পাঠাব।
নিউ বেঙ্গল প্রেস থেকে বেরোনো আমার '51 ছোটদের ছোটগল্প' বইটির কাজ তখন পুরোদমে চলছে।‌ তখন ওদের মাদার কনসার্ন দেব সাহিত্য কুটিরের 'শুকতারা' আর 'নবকল্লোল' পত্রিকা দুটি সম্পাদনা করার জন্য আমাকে খুবই ধরেছিলেন দেব লাইব্রেরির তখনকার সর্বময় কর্তা। আমি বলেছিলাম, সে আমি দেখতেই পারি। কিন্তু আমার মাথার উপরে একজনকে চাই।
উনি জানতে চেয়েছিলে, কাকে?

আমি আর কারও নয়, সরাসরি সুচিত্রাদির কথা বলেছিলাম। ওঁরা রাজি হতেই, ওখানকার দায়িত্বে থাকা সুকুমারদাকে নিয়ে আমি একদিন সুচিত্রাদির‌ বাড়িতে গিয়েছিলাম। কথাবার্তাও মোটামুটি হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু পরের সপ্তাহেই সুচিত্রাদি বললেন, না রে, থাক।
কেন 'থাক' বললেন আমি জানতে চাইনি। কারণ, আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে-মানুষটা শুধু লেখার জন্য ও রকম একটি চাকরি থেকে ভি আর এস নিয়ে নিতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই ওই একই কারণে 'থাক' বলেছেন।

কিন্তু সে সব তো মিটে গেছে। তা হলে এখন! তা হলে কি ওঁর রাগ পড়ে গেছে! আমি যখন ইতস্তত করছি, উনি বললেন--- শুনলাম। কী হয়েছিল রে?
এ রকম যে কিছু শুনব, আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। কারণ, তার আগের দিনই আমার বাবা মারা গেছেন। কাউকেই বলিনি। এমনকী, আমার অফিসেও না। আমার বস গৌতম ভট্টাচার্য তখন বিদেশে। তা হলে উনি জানলেন কী করে!
মনে পড়ে গেল--- সুচিত্রদি যখন বছর দশ-বারো আগে এই বাড়িতে উঠে  এলেন, আমি বলেছিলাম, এ বার তা হলে তো আপনার ল্যান্ড নম্বরও পাল্টে যাবে।
উনি বলেছিলেন,‌ না না।‌ আমি এখানকার সবই নিয়ে যাচ্ছি। ফোনটাও।
আমি বলেছিলাম, সে হয়তো নিচ্ছেন। কিন্তু অন্য বাড়িতে গেলে তো ফোন নম্বরটাও অন্য হয়ে যাবে।
উনি বলেছিলেন, না রে পাল্টাচ্ছে না। পাশেই তো... তাই নম্বরটাও একই থাকছে।

কিছু দিন আগে রাজহংসের মতো সাদা ধবধবে গাড়িটা কেনার পরে যে-উৎসাহ নিয়ে উনি আমাকে নতুন গাড়িটা দেখিয়েছিলেন, তাতেই ধরা পড়েছিল, অত্যন্ত অল্পে খুশি হওয়া একটা আপাদমস্তক ভাল মানুষ।
ভাল না-হলে সর্বাধিক বিক্রিত একটি বিখ্যাত পত্রিকার পুজো সংখ্যায় ছাপার কথা হয়ে যাওয়ার পরেও, ওঁর লেখা উপন্যাসটার জায়গায় যে লোকটা নানা কলকাঠি নেড়ে নিজের এক বন্ধুর লেখা ছেপেছিলেন, গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রয়াত সেই লোকটাকে কিন্তু শেষ শ্রদ্ধা জানাতে সেই বন্ধুটি শ্মশানে পর্যন্ত যাননি। সে দিন অন্য একটা জায়গায় তিনি গল্প পড়তে চলে গিয়েছিলেন। অথচ ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার খবর শোনামাত্র শুধু সুচিত্রাদিই নন,‌‌ তাঁর বাড়ির লোকেরা‌ও‌ সবাই মিলে  রাতদুপুরে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন দিঘার উদ্দেশ্যে। সারাক্ষণ ছিলেন ওই পরিবারের পাশে ‌। পরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা গল্প লিখেছিলেন সুচিত্রাদি। এবং সে জন্য শুধু ওই বন্ধুটিই নয়, ওর বন্ধুবান্ধবদেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। ওঁরা কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।‌ তবু সুচিত্রাদি নিজের জায়গায় স্থির থেকেছিলেন। কারও কাছে মাথা নত করেননি।

সিদ্ধার্থ সিংহ

এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, সুচিত্রাদির উপন্যাসটি ছাপা হয়েছিল একটি ছোট্ট কাগজে। পরে‌ যেটা জনপ্রিয়তা এবং বিক্রির নিরিখে ইতিহাস হয়ে গেছে।‌হ্যাঁ, সেই উপন্যাসটির নাম--- আমি রাইকিশোরী। ও পারে নয়, নতুন একটা ফ্ল্যাট দেখেছিলেন রেল লাইনের এ পারে। লিফট আছে। স্কোয়ার ফুটও ওই ফ্ল্যাটের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু দেখতে গিয়ে দেখা গেল, এটার স্কোয়ার ফুট বেশি হলেও আদতে জায়গাটা তুলনামূলক ভাবে ওই ফ্ল্যাটের চেয়ে অনেক কম। বোঝা গেল, শুধু সিঁড়ি বা আশপাশই নয়, আজকালকার প্রোমোটাররা স্পেস মাপার সময় আকাশ-টাকাশও ধরে নেয়। না। শেষ পর্যন্ত ওই ফ্ল্যাট বাতিল করে দেন উনি।

আমরা যখন সুচিত্রাদির বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় পৌনে একটা। বসার ঘরে একটা সিটও ফাঁকা নেই। কোণের ঘরে ছিলেন প্রদীপদা, কুণালদারা। আমি আর আমার ছেলে সেখানে গিয়ে বসলাম। কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। কত কথা, কত স্মৃতি বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এক্ষুনি বুঝি ডুকরে কেঁদে উঠব। ঠিক তখনই কুণালদা এসে বললেন, সিদ্ধার্থ, মেয়ে না আসা পর্যন্ত তো কিছু হবে না। মনে হয় বেরোতে বেরোতে কাল‌ বেলা দশটা-এগারোটা হয়ে যাবে। কতক্ষণ আর বসে থাকবি! যা বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আয়।

আমরা দু'জনে ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। তখনও সকালের আলো ফোটেনি। কিন্তু বেরোলেই কি বেরিয়ে আসে যায়! এই পৃথিবীতে আসার পর কিছু কিছু সম্পর্ক এমন গভীর ভাবে গড়ে ওঠে, যা রক্তের সম্পর্ককেও‌ ম্লান করে দেয়। ছাপিয়ে ওঠে। আর সেটা যে কতখানি নিবিড় তা বুঝি পাশ থেকে সরে না-গেলে টেরই পাওয়া যায় না। ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর সেই সম্পর্কটাই যেন লতাগুল্ম হয়ে পায়ে পায়ে জড়াতে লাগল।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.