![]() |
ফিরে পাওয়া : কর্ণধর মণ্ডল |
সেদিনের সেই সময়টা ছিলো হেমন্তের রোদ ঝলমল তপ্ত দুপুর। বেরিয়ে ছিলাম মনে আনন্দময় মুহুর্ত নিয়ে। আমি ও সঙ্গে পাঁচ বন্ধু অপুর্ব,শঙ্কর, রাজেশ, অসীম ও হিমাংশু। সুদুর চন্দন নগরের উদ্দেশ্যে। যখন আমরা ছয় জন ক্যানিং স্টেশন গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন দৃষ্টি-গোচর হলো ঝমাঝম্ শব্দ করে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটে আসছে প্লাট্-ফর্মকে ছুঁতে। স্টেশন থেকে দাঁড়িয়ে সেই চলন্ত দৃশ্যায়মান মুহুর্ত খানি আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকলাম। বেশ! কয়েক সেকেণ্ড পর ট্রেন এসে প্লাট্-ফর্মে দাঁড়ালো। শত শত মানুষ যে যার দৈনন্দিন জীবনের কর্ম সেরে গন্তব্যে ফেরার ব্যাস্ততায় দীর্ঘঃপ্রতিক্ষায় দৌড়াচ্ছেন। আমি কিছুক্ষণ সেই জন-অরন্যের ভিঁড়ে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যপট-চিত্র অনুধাবন করলাম। তারপর, ক্রমশ ভিঁড় কমতে ট্রেনের কামরায় আমি ও পাঁচ বন্ধু মহানন্দে উঠে পড়লাম। সবাই সিট্ নিয়ে পাশাপাশি সামনা-সামনি করে বসলাম। আমি বসলাম জানালার পাশে। সবাই নানান গল্প নিয়ে ব্যস্ত। আমিলজানালার পাশে বসে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য হৃদয় ক্যানভাসে মনের মাধুরী দিয়ে লিপিবদ্ধ করতে লাগলাম। তখন হাজার ভাবনা স্মৃতি হয়ে হৃদি-মনে কথিত হতে থাকলো।
কিছুক্ষণ পর, হ্যাঁ! প্রায় পনের থেকে কুড়ি মিনিট পর ট্রেন প্লাট্-ফর্ম হইতে মহানগরীর উদ্দেশ্যে, অভিমুখে যাত্রা শুরু করতেই আমরা দৌড়াতে লাগলাম। গাছ-পালা, ঘর-বাড়ী নিমেশে পিছে ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম। মাইল-স্টোন ফলক গুলো মুহুর্তের মধ্যেই পিছনে ফেললাম। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য! সোনালী ধানের ক্ষেতে বাতাস আলগোছে দোল দিয়ে চলেছে।রৌদ্র'চ্ছায়ায় লুকোচুরি খেলছে পলকে পলকে। দুরে নীল-নিলীমায়,সুনীল দীগন্তে সারি সারি সুভ্র বলাকা খাদ্যের সন্ধানে অসীম শুণ্যে ডানা মেলে ফিরছে। নীচে রোদ্-ঝলমল্ আলো-ছায়ার খেলা। বাতাসেতে নুপুরের সুর-ধ্বনি অনুরাগের ছন্দ আমার বেবাগী-মনে কাব্যিক-ভাবনায় আঘাত হেনেছে অবিরত অনির্বার। সঙ্গে হাজার প্রশ্নের ঝড় আমার অবুঝ মনকে উড়িয়ে নিয় চলেছে অচেনা-অজানা রুপকথার কল্পলোকে।
এমন সময় মধ্য-বয়স্ক এক ভদ্রলোক আমার সামনের সিট্-এ বসলেন।তখন ট্রেন সবে মাত্র পিয়ালী ছেড়ে চম্পাহাটী আসছে। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোকটি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কোথায় নামবেন?
আমি বললাম শিয়াদহ।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,আপনি কোথায় নামবেন?
বললেন, আমিও শিয়ালদহ নামবো।
আপনি কোথায় যাবেন?
বললেন, চুচুড়া। আমার ছেলের কাছে। ওখানে চাকরি করে ।দ্যাখো না বাবা,এই প্রায় চার মাস হয়ে গেল একবাবের জন্য খোঁজ নিলোনা। কি টাকা পাঠালো না।বাড়ীতে অসুস্থ মা আমারও মাথার ঠিক নেই,হাই-প্রেসার,সুগার। সংবাদ নেই। একটুও খোঁজ খবর নেই। ফোন নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছি। এখন অনেক টাকা ইনকাম করছে,নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। তাই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। বলতে বলতে ভদ্রলোকটি কেঁদে ফেললেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,আপনি এখন কোথায় যাবেন?
ভদ্রলোকটি বললেন-আমার ছেলের কাছে। দেখি ওখান কার কারখানার কোন অফিস খুঁজে পাই কি। যাই একবার দেখা করে আসি।
এভাবেই কথা বলতে বলতে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছালো। ওই ভদ্রলোকটি নেমে গেলেন। আমরা ছয়জন নেমে দ্রুত নর্থের দিকে এগিয়ে চললাম। নর্থে পৌঁছে দেখলাম 4নং-প্লাট্-ফর্মে রানাঘাট লোকাল ট্রেনটি অপেক্ষারত। দৌড়ে গিয়ে সবাই ট্রেনে উঠে পড়লাম। প্রচন্ড ভিঁড় যে যার সুবিধা মত জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তখন সময় প্রায় তিনটের কাছাকাছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন প্লাট্-ফর্ম থেকে ছাড়লো। আমরা মহানন্দে চন্দন নগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। একের পর এক স্টেশন ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম। আমাদের গন্তব্য স্টেশন শ্যামনগর। তার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে। মনে মনে একটা আনন্দা'নুভুতি অনুভব করছিলাম।
কারন-চন্দন নগরের আলোক সজ্জায় সজ্জিত জগৎ বিখ্যাত জগর্দ্ধাত্রী মেলা এই সর্বপ্রথম দর্শন করতে চলেছি। জীবনে বহুবার বহু মেলা ঘুরেছি। কিন্তু এই মেলার প্রধান ঐতিহ্য হলো রকমারী আলোক সজ্জা। যা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চারিদিকে শুধু আলো আর আলো। ওলিতে গলিতে বিরাজমান জগর্দ্ধাত্রী প্রতিমা। এমন বিষ্ময় আর অনুভুতি মনের মাঝে ঘুরে ফিরে আসছিল।
অপেক্ষার প্রহর শেষ করে আমাদের গন্তব্য স্টেশন শ্যামনগরে পদার্পন করলাম।এখানে নেমে দেখলাম প্রচুর মানুষের ঢল।এখান দিয়ে টোটো গাড়ী চেপে জগদ্দল ফেরীঘাটে পৌঁছালাম।সেখানে তখন হাজার হাজার মানুষের ভিঁড়।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পারাপারের জন্য ভ্যাসালের টিকিট সংগ্রহ করে একের পর এক ভ্যাসালে চাপলাম।নদী পার হলেই চন্দন নগরের মাটিতে পদার্পন করবো।ভ্যাসালে উঠে যে যেমন ভাবে পারছে মোবাইলে সেলফি তুলতে ব্যস্ত।আমিও কয়েটা সেলফি তুলাম বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে।এরপর মোবাইল রেখে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভুতি অনুভব করলাম।সাইরেন বাজার সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাসাল ছেড়ে দিলো ওপারের উদ্দেশ্যে।বেশ,কয়েক মিনিট যাওয়ার পর চন্দন নগর ফেরীঘাটে নোঙর বাঁধলো।ধীরে ধীরে একের পর এক নেমে পড়লাম।
চন্দন নগরে যখন পৌঁছালাম,পশ্চিম দীগন্তে বেশ কয়েক প্রহর বেলা তখন দণ্ডায়মান।আমরা সবাই হাত মুখ ধুয়ে গঙ্গা তীরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম।ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর হাল্কা করে টিফিন করে নিলাম সবাই মিলে।তখন দিনের সুর্য অস্তাগত পশ্চিম দীগন্তের অসীম অন্তঃনীলে।নদীর জলে এই অপরুপ মনোলোভা দৃশ্যপট হৃদয় মনকে মোহিত করে দিয়ে গেল।এই অনিন্দ্য চিত্রপট আমি মর্মে মর্মে অনুভব করলাম।
তারপর আমরা ছয় জন বন্ধু উঠে পড়লাম কাল বিলম্ব না করে।তখন অপরুপ চিত্ত হনন করা আলোক সজ্জায় সেজে উঠেছে মহানগরী চন্দন নগর।চারিদিকে শুধু আলো আর আলো।আলোক রসনায় ঝলমলে।যত দুর চোখ যায় শুধু আলোক ময় আলোক সজ্জা।সেই চোখ ধাঁধানো রঙীন আলোর ঝর্ণার মধ্যে দিয়ে আমরা পথ চলতে লাগলাম।প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে আলোক সজ্জায় রঞ্জিত জগর্দ্ধাত্রী প্রতিমা একের পর এক দর্শন করতে থাকলাম।রাস্তা অজস্র সহস্র মানুষের ঢল।রাস্তার দু-পাশে পাঁপড়,জিলাপী,জিভেগজা,কটকটি রকমারী খাবারের দোকান।আর মন কাড়া দৃষ্টি মজানো স্টেশনারী দ্রব্য সামগ্রী।এই সব উপেক্ষা করে আমরা এগিয়ে চললাম প্রতিমা দর্শন করতে ও বিনোদন আলোক সজ্জা উপভোগ করতে।
এই ভাবে,প্রতিমা দর্শন ও আলোর ঝর্ণার স্রোতে গা ভাসিয়ে এগিয়ে চললাম বেশ কয়েক মাইল পথ।যত দুর চোখ যায় শুধু আলো আর আলো।
মন কে প্রশ্ন করলাম........
''এ আলোর শেষ কোথায়?
কোথায় এর আদি-অন্তঃ.....
যত দুর চোখ যায় শুধু আলোয় আলোকময়!
আলোয় সজ্জিত রঙিন সুদুর দীগন্ত''।
শুধু পথ আর পথ হেঁটে চললাম।নেই ক্লান্তি,নেই বিশ্রাম শুধুই আকাঙ্খা।নতুন কিছু দেখবার জানবার।হঠাৎ দেখলাম রাস্তার উপর একটা ছোট্ট বাচ্ছা শুয়ে কাঁদছে।আর তার মা ভিক্ষা দাও ভিক্ষা দাও।আমার ছেলেটা দুদিন কিছু খায়নি।দেখে খুব কষ্ট লাগলো ।সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে খুচরো প্রায় দশ টাকা মতো বের করে দিলাম।আমাদের মধ্যে আরেক জনও কয়েক টাকা দিয়েছে। অন্য একজন দেখে বললো টাকা দিচ্ছো এটা ওদে ইনকামের কৌশল। তা যাই হোক,আমরা প্রতিমা দর্শন করতে এগিয়ে চললাম।কিছুটা পথ যাওয়ার পর দেখলাম একই ঘটনা।লোকের ভিঁড়ের মধ্যে দেখলাম এক মা তার বাচ্ছাকে মারছে কাঁদছে না বলে।কয়েক বার মারার পর যখন কাঁতে শুরু করেছে। তখনি তার মা বাবু ভিক্ষা দাও,ভিক্ষা দাও বলে চেঁচাতে শুরু করলো।পাশে থেকে দাঁড়িয়ে দেখে অাশ্চার্য হয়ে গেলাম।অবাক দুনিয়ায় কত রকমের মানুষ বাস করে।কেউ কাঁদাতে ব্যস্ত।আবার কেউ হাসাতে ব্যস্ত।
এই ভাবে পথ চলতে চলতে,নানা প্রশ্নের ঝড় মনে আঘাত করতে থাকে।এই বিশাল পৃথিবীটা একটা রঙ্গময় নাট্যশালা।আমরা যে যেমন পারি সেই ভাবে অভিনয় করে চলি।কেউ পাওয়ার আশায়,কেউ দেওয়ার আশায়।আমরা এই আশা নামক মরিচিকার পিছনে ছুটে চলেছি তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো।সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পুর্বের মুল স্রোতে ফিরে আসলাম।ঘুরতে ঘুরতে প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেল।সবাই খাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।আবার হাঁটতে হাঁটতে পুর্বের স্থান গঙ্গার তীরে উপস্থিত হলাম খাওয়া দাওয়ার কাজটা সারার জন্য।খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলো। ষে যার মতো আশে পাশে বসে বিশ্রাম নিতে থাকলাম।
এমন সময় চোখে পড়লো অনতিক্রোশ দুরে মনে হলো ট্রেনে সাক্ষাৎ হওয়া সেই ভদ্রলোকটা বসে রয়েছেন।কাছে গিয়ে দের্জনে একাকী বসে আপন মনে কি সব বলছেন।দেখে মনে হলো যেন ব্রেনের কোন সমস্যা আছে।যাই হোক....
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম,
ও কাকু কি ব্যপার!
এখানে বসে রয়েছেন কেন?
আপনার ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
ভদ্রলোকটি বললেন না ।
বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন।
--এখন কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা।কাছে যে কটি টাকা ছিলো,সব খরচ হয়ে গিয়েছে।কিভাবে বাড়ী ফিরবো ভেবে পাচ্ছি না।
ঠিক আছে,উপায় একটা হয়ে যাবে।আপনি চোখের জলটা মুছুন।
--আপনার নামটা বলুন?
--ভদ্রলোকটি বললেন আমার নাম সতীশ বিশ্বাস।
--আপনার বাড়ীটা কোথায় বলুন?
--ভদ্রলোকটি বললেন সুন্দরবন, রাধারানী পুর।
--আপনার ছেলের নাম কি?
--আমার ছেলের নাম শুভাশীষ বিশ্বাস।
--আপনার ছেলে কোথায় চাকরি করেন?
--হুগলীর চুঁচুড়ায় পাটকলে।আর.এন.জুটমিল এন্টারপ্রাইজ প্রাঃলিঃ।
--বেশ,আপনি এই কোম্পানীটা কোথায় জানেন?
--হ্যাঁ বাবা জানি।আমি কত বার গিয়েছি।
--এখান থেকে কত দুর হবে?
--না খুব বেশী হলে এক মাইল ।
--তাহলে আপনি এখুনি আমার সাথে চলুন।বলতে বলতে ভদ্রলোকটিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চুঁচুড়ায় জুটমিলের সামনে পৌঁছেলেন।এক দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম,শুভাশীষ বিশ্বাস নামে কোন শ্রমিককে চেনেন?
--দারোয়ানটি বললেন না বাবু সাব।পাতা নেহি।
--খানিকটা দুরে আর একটি গেট।দেখি ওখানকার দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে।সামনে গিয়ে জানতে চাইলাম বলতে পারলেন না।হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি একটা বুদ্ধি খাঁটালাম।যদি ফেসবুকের মাধ্যমে খোঁজ নেওয়া যায় তাহলে কেমন হয়।বলতে বলতে ফেসবুক অন করে শুভাশীষ নামে সার্চ করতে আট-দশটা প্রোফাইলের ছবি ভেসে উঠলো।সতীশ বাবুকে দেখালাম বললেন না কোনটাই আমার ছেলে নয়।আবার ইংরাজী স্পিলিংএ নাম লিখে সার্চ করলাম।চারটে প্রোফাইলের ছবি ভেসে উঠলো।সতীশ বাবুকে দেখালাম।বললেন প্রথম ছবিটাই আমার ছেলে শুভাশীষের।
বেশ,আপনি ধৈর্য ধরে বসুন।চেষ্টা করে কি করা য়ায়।সময় নষ্ট না করে বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠালাম।দু-তিন মিনিট পর এপসেট করেছেন।সঙ্গে সঙ্গে ইনবক্সে চ্যাট করলাম।কিছুক্ষণ আলাপ বিনিময় করার পর জানতে পারলাম।পাঁচ-সাত মিনিটের পথ হবে শুভাশীষ বাবুর বাঁসা।আমি বললাম শুভাশীষ বাবু আমি আপনার বাঁসার কাছে এসেছি বড়ো বিপদে পড়ে গিয়েছি আপনি যদি আসেন খুব উপক্রিত হবো।
ঠিক আছে,আপনি কারখানার সামনে দশ মিনিট দাঁড়ান আমি আসছি।
আমি ও সতীশ বাবু দাঁড়িয়ে রইলাম।কিছুক্ষণ পর বয়স্ক দারোয়ানটি সতীশ বাবুকে দেখে চিনতে পারলেন।
--কি সতীশ ভাই কেমন আছেন?
--সতীশ বাবু চিনতে পারলেন না।হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
--আমি দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সতীশ বাবুকে চেনেন।
--বাবুসাব,সতীশ বাবুকে চিনবোনাই,বড়ো কাজ পাগল লোক ছিলে।বড়ো দিলদার লোক ছিলেন।কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পাগলের মতো এই কারখানার সামনে ঘুরে বেড়াতেন।গত তিন-চার সাম মতো ওনাকে আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। কথা বলতে বলতে দেখতে পেলাম একটা হুইল চেয়ারে বসে কে একজন আসছে,এক ভদ্রমহিলা ঠেলে নিয়ে আসছেন।দুর থেকে ল্যাম্প-পোষ্টের আলোতে খুব একটা বাঝা যাচ্ছে না।কাছে আসতেই সতীশ বাবু অবাক হয়ে গেলেন।স্তব্ধ হয়ে গেলেন।ঠকঠক করে কাঁপছেন।নিজের সন্তানকে এমন অবস্থায় দেখে।একমাত্র সন্তান।তার শেষ সম্বল-আশা-ভরসা।সতীশবাবু কাঁদতে কাঁদতে শুভাশীষকে জড়িয়ে ধরলেন।শুভাশীষের দু-চোখ দিয়ে বেদনা'শ্রু ঝরতে থাকলো।বাবা-ছেলে দুজনেই কাঁদে কারো মুখে কোন ভাষা নেই।
আমি সতীশবাবুর ছেলেকে বললাম,এতদিন বৃদ্ধ বাবা-মাকে ছেড়ে বিদেশে পড়ে আছেন।এনাদেপ প্রতি একটু খেয়াল রাখুন।খোঁজ খবরটা ঠিক মতো রাখুন।
--বিদেশ মানে কি ঠিক বুঝলাম না।
--আপনি তো সুদুর সুন্দরবন, রাধারানী পুর থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছেন?
--দাদা,আমার বাড়ীতো এই চুঁচুড়াতে ।
--তাহলে আপনার বাবা বললেন সুন্দরবন,রাধারানী থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছেন।
না দাদা,আমার বাবা একজন মেন্টালিটিস প্রেসেন্ট।এই কারখানাটা দেখতে পাচ্ছেন।এখানে দীর্ঘঃ ত্রিশ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন।একদিন হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়।সময় কালটা ছিল 2015 সাল।আমার বাবা ও কমলেশ বাবু একই সাথে কাজ করতেন।পরস্পর দুজনে ছোট্ট বেলার বন্ধু।কারখানার কয়েকটা মেশিনে সমস্যা ছিল কমলেশ বাবু জানতেন না।যখনি মেশিন চালু করে কাজ শুরু করেছেন ।হঠাৎ মেশিনে হাত আটকে গিয়ে দুটি হাত কেটে পড়ে যায়।সেই দৃশ্য দেখে বাবা খুব মানসীক ভাবে আঘাত পায়।এরপর যখন ন্যায্য দাবী নিয়ে শ্রমিকেরা মালিকের কাছে কমলেশ বাবু সম্পুর্ন সুস্থ হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসার খরচ ও সংসার চালানোর ভার নিতে মালিকপক্ষকে বাধ্য করে।মালিক না মানায় শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেন।মালিকের আরো কয়েকটা কারখানা থাকার জন্য এই কারখানাটি বন্ধ করে দেয়।দরিদ্র অসহায় খেটে খাওয়া শ্রমিক কমলেশবাবু বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
একদিকে বন্ধু মারা যাওয়ার শোক অন্যদিকে কারখানা বন্ধ আর্থিক অনটন।এই ভাবে কিছুদিন যেতে যেতে বাবার চলাফেরার মধ্যে কেমন যেন অস্বাভাবিক লক্ষন দেখা যাচ্ছিল।বড়ো বড়ো হসপিটালে দেখি উন্নতি কিছু হয়নি।বরং ক্রমশ অবনতির পথে এগিয়ে চললো।আপনমনে নিজের সাথে নিজে কখা বলতে থাকে।টিফিন-বক্সে খাবার ভরে নিয়ে গিয়ে কারখানার সামনে বসে থাকতো।সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরতো।এই ভাবে কেটে গেল কয়েক বছর।গত কয়েক মাস আগে আমার একটা এক্সিডেন্ট্ হওয়াতে প্রায় পঙ্গু হয়ে যাই।হাঁ-চলা না করতে পারায়,বাবার প্রতি নজর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এরই মাঝে ঘটে গেল এক চরম ইতিহাসের কাহিনী।গত চার মাস ধরে বাবাকে খুঁজে পাঁয়া যাচ্ছে না।চারিদিকে বন্ধু-বান্ধব,আত্মীয়-স্বজনের কাছে খোঁজ খবর নিয়ে বাবার কোন সন্ধান পাওয়া গেল না।তারপর ফেসবুক প্রোফাইসে বাবার ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম।গত-15.05.2019 তারিখে,চুঁচুড়া প্লাট্-ফর্ম্ থেকে হারিয়ে যায়।সতীশ বিশ্বাস নামে এই ব্যাক্তি।পরনে ছিল খদ্দরের পাঞ্জাবী ও সাদা ফুল প্যান্ট।বয়স-48-50,গায়ের রং ফর্সা।উচ্ছতা-5 ফুট 8 ইঞ্চি।যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি খোঁজ পান,তাহলে নীচের এই নং-9766666332 যোগাযোগ করবেন।
ধন্যবাদ,আমি আসি শুভাশীষ বাবু।আবার হয়তো কোন একদিন দেখা হবে।আপনার প্রিয় মানুষকে হলো-"ফিরে পাওয়া"।হারানো পিতাকে সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে,আমি ফিরে আসলাম আমার সঙ্গীদের কাছে।তখন রাত আড়াই টা বাজে।বললাম এবার ফেরা যাক।বলতে বলতে ঘাটে ভ্যাসাল এসে দাঁড়ালো।টিকিট কেটে ভ্যাসালে চেপে নদী পার হয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে টোটো চেপে রওনা দিলাম।স্টেশন থেকে যখন ট্রেন ছাড়লো,তখন পুব্-গগনে সুর্য সোনালী স্নিগ্ধ আলোর বিচ্ছুরনে পৃথিবীকে করেছে আলোকজ্জ্বল মোহময়ী।সেই সু-প্রভাতের স্নিগ্ধ-ধারাপাতে সোনালী আলো মেখে বাড়ীর অভিমুখে যাত্রা শুরু করলাম।
''ফিরে পাওয়া''র অপেক্ষায়........
সমাপ্ত
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন