অচেনা সহযাত্রী : প্রসেনজিৎ রায়

অচেনা সহযাত্রী : প্রসেনজিৎ রায়
অচেনা সহযাত্রী : প্রসেনজিৎ রায়

রাত ৩.৫০ মিনিটে ত্রিপুরাসুন্দরী এক্সপ্রেস কুমারঘাট রেলস্টেশনে থামলো। নেমে দেখি চারদিক খুব অন্ধকার। গুয়াহাটি থেকে তিন মাসের প্রশিক্ষণ সেরে বাড়ি ফিরছি। মা বাবাকে কতদিন পর দেখবো, ভেবে দেরী না করে টমটম খুঁজতে স্টেশনের বাইরে গেলাম। গিয়ে দেখি হাতে গোনা ৪ টি টমটম ছাড়া কোনো গাড়ি নেই। আমার বাড়িটা যে জায়গায় আমাকে একা নিয়ে যেতে কেউ রাজি নয়, বাকি যে ১৪- ১৫ জন নেমেছে কুমারঘাটে তাদেরকে নিয়েই সবাই রওনা  দিল। মেন রোড করে বাড়ি যেতে প্রায় ৩০ -৩৫ মিনিট হাঁটতে হয়, বরং স্টেশন থেকে একটা শর্টকাট ধরে ৭ - ৮ মিনিট হাঁটলেই বাড়ি। ভাবলাম ঐ পথই ভালো, কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকার। অনেক ভুতুড়ে গল্প শুনেছি ঐ শর্টকাট রাস্তাকে ঘিরে। 

পেশায় পুলিশ বলে কি আর মনে ভয় থাকতে নেই ! যদিও কারো সামনে এ ভয় ভুলেও প্রকাশ করি না।  তাছাড়া অন্ধকারে সাপ টাপের ভয়কে অগ্রাহ্য করাটা বোকামী। ভাবলাম স্টেশনের ভেতরে গিয়ে দেখি কোনো পরিচিত লোক পাই কিনা যে ঐ রাস্তা দিয়ে যাবে।  যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। তবে ভাগ্য বোধহয় আজ বিরূপ, আমি ছাড়া চারদিকে একটা মানুষও নেই। মোবাইলে চোখ রেখে দেখলাম রাত ৩.৫৯, মানে ৩০ -৪০ মিনিট পর দিনের আলো ফুটবে। ভাবলাম প্ল্যাটফর্মে বসে এই সময়টুকু কাটিয়ে নেই, একটু আলো হলেই রওনা দেবো শর্টকাট রাস্তা ধরে।

প্ল্যাটফর্মে বসে বসে মোবাইল টিপছি। হঠাৎ কোথা থেকে একটা লোক আমার পাশে এসে বসলো।  পুলিশে ৩ বছর চাকরির সুবাদে আর যাই হোক, সন্দেহ করতে শিখেছি সবাইকে কারণে অকারণে।  কোনো চোর নয়তো, সাথে চোরের গ্যাং নেই তো। সাথে তো এখন রিভলবারও নেই।  চারদিকে তাকাচ্ছি আর কেউ আছে কিনা।
লোকটা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো- আপনি কি ঐ শর্টকাট রাস্তাটা করে যাবেন?
আমি বললাম- হ্যাঁ?
- চলুন তাহলে, আমিও যাবো, অন্ধকার একা যেতে ভয় লাগে ,এখন দুজন আছি, চলে যাব।
আমি মনে মনে ভাবলাম, লোকটির মতলবটা কি, চোর ডাকাত নয় তো, রাস্তায় তার গ্যাং এর লোকটোক থাকতে পারে, আর না জেনে অপিরচিত লোকের সাথে যাওয়াটা ঠিক হবে না, এমনিতেই সৎ পুলিশের শত্রুর অভাব নেই।
আমতা আমতা করে বললাম- না পায়ে ভীষণ ধরেছে,একটু বিশ্রাম করে যাবো। লোকটি বলল- কি অপরিচিত লোকের সাথে যেতে ভয় পাচ্ছেন নাকি পুলিশ হয়েও ...
--- আপনি কি আমায় চেনেন?
----হ্যাঁ, আপনাকে ভালো করেই চিনি....চলুন বিশ্বাস রাখতে পারেন।
কি আর করবো, সাহসের প্রশ্ন........অগত্যা উঠে পড়লাম যাবার উদ্দেশ্যে মোবাইলে টর্চ জ্বেলে।
যেতে যেতে লোকটি জিজ্ঞেস করলো - আপনারা যে এতো ক্রিমিনাল নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন,হুমকি তো নিশ্চয়ই আসে | ভয় করে না ?
---ভয় পাইনা ঐসব গুন্ডাদের |  হুমকি পেয়ে কেস ঘাটা ছেড়ে দেবো এমন মানুষ আমি নই।  যে কুকুর বেশী ঘেউ ঘেউ করে তারা কখনো কামড়ায় না, এরাও ঠিক এমন।
—হয়তো ঠিক বলছেন, কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দিতে নেই। আমিও একই ভুল করেছিলাম, জানেন এই পাপীদের কোনো বিচারও হয় না।
—বুঝলাম না, ঠিক কি হয়েছে বলুন। —শুনুন তাহলে | আমি একসময় সাংবাদিক ছিলাম, আর আপনাদের নেতা প্রশান্ত বাবুর (কাল্পনিক নাম) একটা নাবালিকা ধর্ষণের সব প্রমাণ আমি পেয়ে গেছিলাম, কিভাবে এ খবর শয়তানটার কাছে পৌঁছে যায় জানি না? আমাকে ফোনে অনেক হুমকি দিয়েছিল, শুনিনি.....আমার কাগজে সব ছেপে দিয়েছিলাম।
— তারপর ?
— তারপর আর কি, একদিন আমার অফিস থেকে রাত করে ফিরছিলাম , বৃষ্টি হচ্ছিল | হঠাৎ রাস্তায় ওর পোষা গুন্ডা কালুর( কাল্পনিক নাম) সাথে দেখা ,খুব শাসালো, আমাকে পস্তাতে হবে, অনেক বড় ভুল করেছি, এসব।  আমিও বললাম, যা পারিস করে নিস, তোদের মতো কুত্তাদের আমি ভয় করে চলি না, হঠাৎ কিছু না বলেই আমার পেটে ছুরি চালালো।

 হঠাৎ একটা কি পাখি আমার গাঁ ঘেঁষে উড়ে গেলো | আমি তারপর বলে পিছে তাকাতেই দেখি কেউ নেই। আর আগপিছ কিছু না ভেবেই রাম, রাম চিৎকার করে এক দৌঁড়ে মেন রোড।  ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে মাত্র। প্রথমে ভাবলাম ভাগ্যিস রাম, রাম বলে দৌঁড়টা কেউ দেখেনি। এরপর বুঝলাম সত্যিই তো প্রশান্ত, কালু এরা আজ সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি | লোকটা তার প্রতি কৃত অন্যায়ের নালিশ আমার কাছে করে গেলো এভাবে।  আমাকে ওদের শাস্তি দিতেই হবে।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.