বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রয়োজন ষড়যন্ত্রের শ্বেতপত্র প্রকাশ : ঝর্ণা মনি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রয়োজন ষড়যন্ত্রের শ্বেতপত্র প্রকাশ ঝর্ণা মনি
 

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রয়োজন 

ষড়যন্ত্রের শ্বেতপত্র প্রকাশ
 

ঝর্ণা মনি

 
‘কী চাস তোরা? বেয়াদবি করছিস কেন?’ গর্জে ওঠে বজ্রকণ্ঠটি। পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে ঘাবড়ে যায় ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দীন। কাঁপতে কাঁপতে হাত থেকে পড়ে যায় পিস্তল। ‘স্টপ! দিস বাস্ট্রার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ’- গর্জে ওঠে ঘাতক নূর চৌধুরীর স্বয়ংক্রিয় স্টেনগান। মাত্র সাত ফুট দূর থেকে ১৮টি গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দেয় ধ্রুবতারাটির দেহ। কৃষ্ণগহ্বরের রাতে বৃষ্টির মতো গুলিতে ঝাঁঝরা ছয় ফুট দুই ইঞ্চির বিশাল দেহ মুখ-থুবড়ে পড়ে সিঁড়িতে। বুকের ডান দিকে গুলির বিরাট ছিদ্র। যে উঁচু করা তর্জনী ছিল পাকিস্তানের ভয়ের কারণ আর সন্তানসম বাঙালির আস্থার প্রতীক, ঘাতকের ব্রাশফায়ারে উড়ে যায় সেই তর্জনীটি। অবশ্য ডান হাতে আঁকড়ে ধরা ছিল ধূমপানের প্রিয় পাইপ। আগস্ট আর বর্ষণস্নাত শ্রাবণ মিলেমিশে একাকার হয়েছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর রক্ত আর আকাশের মর্মছেঁড়া অশ্রুর প্লাবনে।

সেদিন শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। অভিশপ্ত দিনে হতবিহ্বল জাতির চারদিকে ছিল ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন। মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তচিহ্নসহ জনকের লাশ। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে থাকা দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে, ছাদের ৩২ নম্বর ধানমন্ডিকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল ইতিহাস থেকে।

খুনীদের রক্ষার দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র: হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচার না করে বরং তাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল রাষ্ট্র। পঁচাত্তরের ২৬ সেপ্টেম্বর খুনি মোশতাক জারি করেন ক্যুখাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স। আর ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটিকে আইন হিসেবে অনুমোদন করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এভাবেই রুদ্ধ হয়ে যায় স্বধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটনের সকল অর্গল। মুখোশ উন্মোচিত হয়নি কলঙ্কিত পনেরো আগস্টের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে বাতিল করেন ইনডেমনিটি আইন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কার্যকর হয় বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ ও এ কে এম মহিউদ্দিনের ফাঁসি।

২০১৭ সালে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে বঙ্গবন্ধুকে খুনে যারা সরাসরি জড়িত ছিলেন, তাদের বিচার হলেও স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় অন্তরালে থেকে যারা বাঙালির জাতির পিতাকে হত্যার ছক করেছিলেন, তাদের চিহ্নিত করতে কমিশন গঠনের কথা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে একাধিক অনুষ্ঠানে কমিশন গঠনের কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। তবে গঠিত হয়নি ইতিহাসের সবচেয়ে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনের তদন্ত কমিশন। 

কেন প্রয়োজন তদন্ত কমিশন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবার ও জাতীয় চার নেতা হত্যার ঘটনায় প্রথম অনুসন্ধান কমিশন গঠিত হয় যুক্তরাজ্যে, ১৯৮০ সালে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী শন ম্যাকব্রাইডসহ চার ব্রিটিশ আইনবিদ মিলে এ কমিশন গঠন করেছিলেন। তবে অনুসন্ধানের কাজে এ কমিশনকে বাংলাদেশের ভিসা দেয়নি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকার। এ কমিশনকে দেশে আসতে না দেয়ার মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদের প্রতি সামরিক সরকারের সরাসরি সমর্থন ছিল। সরকার এর তদন্তকাজ বাধাগ্রস্ত করেছিল।

কলঙ্কিত এই হত্যাকাণ্ডের ৪৫ বছর পর তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি আরো জোরালো হয়েছে। কারণ আজও সব তথ্য আমরা জানি না। খুনিরা কিভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল, কারা কারা জড়িত ছিল, কার মৌন সমর্থন ছিল সব জাতির জানা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, নথিপত্রও প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু একটা সামগ্রিক পটভূমি, যে পটভূমিতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে বড় ধরনের তদন্ত কমিশন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা প্রয়োজন। এই কমিশন দেখবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশি-বিদেশি শক্তির কারা জড়িত। কেন, কি কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ডের সঠিক ইতিহাস কেনেডি হত্যাকাণ্ডের পর ওয়ারেন কমিশন হয়েছিল। ৫০ বছর হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে কমিশন হওয়া উচিত। কারণ এখনো দেশে-বিদেশে কুশীলবদের অনেকেই বেঁচে আছেন।

মোশতাক-জিয়া পরিকল্পনাকারী আর জল্লাদের ভূমিকায় ফারুক-রশীদ-ডালিম-নূর : যুক্তরাজ্যে গঠিত কমিশনের ‘শেখ মুজিব মার্ডার ইনকোয়ারি : প্রিলিমিনারি’ প্রতিবেদনে ১৩ সামরিক কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়। প্রতিবেদনে লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশিদ এবং মেজর শরিফুল হক ডালিমকে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত আরো অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা হলেন- লে. কর্নেল আজিজ পাশা, মেজর মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর বজলুল হুদা, মেজর এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, মেজর শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন কিশমত হোসেন, লেফটেন্যান্ট এম খায়রুজ্জামান এবং লেফটেন্যান্ট আবদুল মাজেদ। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক ও রশিদ পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর ব্যাংকক চলে যান। ব্যাংককে এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, তার পরিবার এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন কর্নেল ফারুক। ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের সানডে টাইমসে এবং ওই বছরের ২ আগস্ট লন্ডনে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন ফারুক।

আর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার বিষয়ে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয় কর্নেল রশিদ। সাক্ষাৎকারে খুনি রশিদ বলেছিল, শেখ মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমাদের বলেন, ‘আমাকে এ ব্যপারটিতে সরাসরি না জড়িয়ে তোমরা জুনিয়ররা যা পার তা করে ফেল।’ জিয়াউর রহমান পনেরো আগস্ট বিকালেই বঙ্গভবনে মেজর রশীদের কাছে সেনাপ্রধান হওয়ার জন্য ঘুর ঘুর করছিল। ১৬ বা ১৭ আগস্ট সাবেক মন্ত্রী সাইফুর রহমানের গুলশানের বাসায় সাইফুর রহমান, রশীদ ও জিয়ার উপস্থিতিতে জিয়াকে সেনাপ্রধান করার ঠিক হয় এবং এও ঠিক হয়, পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট হবে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবরে শাফায়াত জামিলকে জিয়া বলেছিলেন, ‘প্রেসিডেন্ট যদি না বেঁচে থাকেন, ভাইস-প্রেসিডেন্ট তো রয়েছেন। তোমরা হেড কোয়ার্টারে যাও এবং পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করো।’

জেনারেল জিয়া ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা না নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের সমর্থন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরে ক্ষমতায় আসা মোশতাক-জিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কলঙ্কিত এই হত্যার সঙ্গে জড়িত। খন্দকার মোশতাক সুযোগসন্ধানী এবং অত্যন্ত চতুর। তার আচরণই ছিল ব্যাঙ্গাত্মক। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলতো। সবসময় বঙ্গবন্ধুর কাছে কাছে থাকতো। ১৩ আগস্ট নিজের বাড়ি থেকে রান্না করা হাঁসের মাংস নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাইয়ে ছিল। অথচ খন্দকার মোশতাকই রচনা করেছে বঙ্গবন্ধুর রক্তের সিঁড়ি। আর জল্লাদের ভূমিকায় ছিল ফারুক-রশীদ-ডালিম-নূর চৌধুরী গংরা। হত্যাকাণ্ডের সুফলভোগী তারাই ছিল। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাই জড়িত ছিলেন। আপসহীন জাতীয় চার নেতা খুনী মোশতাককে নাকচ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠ সহচরসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মোশতাকের সভায় শপথ নেন কিভাবে? আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদসহ কারাগারে থাকা কতিপয় নেতাকর্মী ছাড়া কারাগারের বাইরে থাকা নেতাকর্মীরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করেননি। প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। অনেকেই জিয়ার মতোই সুফলভোগী!

মুজিব উৎখাতের কথা জানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-পাকিস্তান-সৌদি-লিবিয়া! : বঙ্গবন্ধু হত্যা একক দেশীয় ষড়যন্ত্র ছিল না। সেনাবাহিনীর কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা অফিসার মিলে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা করে বিষয়টি মোটেই এত সরল নয়। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ মদদ ছিল বিদেশিদের।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’, বুলগেরিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’সহ একাধিক বিদেশি সংস্থার কাছে। সম্ভাব্য এই ক্যু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি এবং বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূতও বঙ্গবন্ধুর কাছে ষড়যন্ত্রের সংবাদ পৌঁছেছিলেন। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শেখ মুজিবকে অবহিত করার জন্য ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাওকে ঢাকায় পাঠান ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধু হেসেই উড়িয়ে দেন জেনারেল কাওয়ের আশঙ্কা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংগঠিত হচ্ছেÑ পঁচাত্তরের মার্চে কাওয়ের কাছে এমন সংবাদ পেয়ে দ্রুত মুজিবকে অবহিত করেন ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নীরব ভূমিকায় থাকলেও ইন্দিরা গান্ধী, ‘র’ এর সতর্কতাকেই তেমন একটা গুরুত্ব দেননি বঙ্গবন্ধু। সন্তানস্নেহে অন্ধ পিতার মতোই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের কেউ তার বুকে অস্ত্র তাক করতে পারে এমন কথা তিনি ভাবতেই পারেননি।

পঁচাত্তরের পনের আগস্ট পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। ‘ইন্দিরা গান্ধী : এ বায়োগ্রাফি’ শীর্ষক বইয়ে ভারতীয় লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে তার (ইন্দিরা গান্ধী) বাসভবনে যাই। আমি দেখতে পাই, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে মহাআতঙ্কিত। ইন্দিরা গান্ধী আমাকে বলেন, মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা। এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। মুজিব ইতিমধ্যেই প্রস্থান করলেন। ইন্দিরা বিভিন্ন প্রমাণ ও যুক্তি দেখিয়ে বলেন, পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি নিজেই। মুজিবের শিশু ছেলেকে হত্যার খবর সব ধরনের শুভ চিন্তাকে ধ্বংস করে দেয়। ভয়ভীতিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। ইন্দিরা বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তেমনটি আমি আর করতে পারি না।

১৯৭৯ সালের পনেরো আগস্ট লন্ডনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত বিশ্ব্যখাত সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ ‘মুজিব হত্যার আড়ালে লুকায়িত নেপথ্য’ কাহিনি তুলে ধরেন, মোশতাক গংরা ১ বছরের বেশি সময় ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানত। অন্তত ৬ মাস আগে থেকে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা-বৈঠক চলছিল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে জানুয়ারি ৭৫ পর্যন্ত বহু বৈঠক তাদের মধ্যে হয়। মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ প্রধান ফিলিপ চেরি জানতেন। যদিও তিনি পরে তা অস্বীকার করেছেন। আর পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে ফের এক করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মাতেন জুলফিকার আলির ভুট্টোর বিশেষ দূত মাহমুদ আলি। এই উদ্দেশ্যে পঁচাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর তিনি লন্ডনে যান এবং ৩ সপ্তাহ ঢাকার সিগন্যাল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। অবশেষে সিগন্যাল না পাওয়ায় পাকিস্তানে ফিরে যান তিনি।

পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ যে জড়িত ছিল; বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণই দিয়েছে। পাকিস্তান নিজে বাংলাদেশের নয়া সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি তারা ইসলামি ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেও অনুরূপ স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানায় এবং মোশতাক সরকারে প্রতি বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ৫০ হাজার টন চাল এবং দেড়কোটি গজ কাপড় উপহার দিয়েছিল।

আমেরিকাও নতুন অবৈধ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট  টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের খবর সর্বপ্রথম আমেরিকাই পেয়েছিল। সেই সুবাধে ১৫ আগস্ট সকাল থেকেই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই অভ্যুত্থানের খবর ফলোআপ করছিল। এমনই এক বার্তায় বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত বোস্টার বাংলাদেশ বেতারের উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন, শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন। খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সরকার গঠন করেছে। মুজিবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ওয়াশিংটন স্টেট ডিপার্টমেন্ট মুখপাত্র এক প্রেসব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নয়া সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক কাজ কম চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোও ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের’ প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান এবং এই ধারণা সৌদি আরবকেও দেয়ার চেষ্টা করেন। এ থেকে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা ভুট্টো আগেই অবহিত ছিলেন। লিবিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মর্যাদার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। এতে মনে হয়, আগে থেকে লিবিয়া না জানলেও পরে সবকিছু জানত এবং হত্যাকাণ্ডে তাদের পূর্ণ সমর্থন ছিল। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) তোয়াব ইসলামি ভাবধারা প্রচার করেছিলেন! তখন লিবিয়া সমর্থন করে। একসঙ্গে সভাসমিতিতে যোগ দেয় লিবিয়ার রাষ্ট্রদূত। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। বরং পাকিস্তানের পক্ষেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকেও সমর্থন জানায়নি। স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে চীন। এরমানে তারা বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশ চেয়েছিল!

আন্তর্জাতিকভাবে সৌদি-পাকিস্তানি চক্র, আমেরিকা-চীন চক্র বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কথা জানত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই হত্যাকারীরা যেভাবে সহজে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে আশ্রয় পেল, তা প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র ছিল এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক বিশ্ব পরিকল্পনা নস্যাৎ করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো- এটি নিক্সন-কিসিঞ্জার মানতে পারেননি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল পাকিস্তানের জন্য চপেটাঘাত। মার্কিন ডিকটেক্ট ও চীনাদের মার্কিন ও পাকিস্তান প্রীতিকে নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি দেশ স্বাধীন করেছিল এটি তাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। অতিবামরাও বঙ্গবন্ধুকে সরানোর জন্য ভুট্টোর সাহায্য চেয়েছিল এবং দেশেও ‘বিপ্লব’-এর নামে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল। এ সমস্ত মিলে তৈরি হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি।

Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.