![]() |
সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য |
সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য
ইতিহাসে এমন বহু বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে,যাকে ঘিরে যুগে যুগে মানুষের মধ্যে দুর্নিবার কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে ,যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে, যার অস্তিত্ব সন্ধানে মানুষ বার বার প্রয়াসী হয়েছে। এই ধরণেরই একটি বিষয় হল একটি পৌরাণিক নদীর অস্তিত্ব প্রসঙ্গ।'সরস্বতী'- এই শব্দটির সঙ্গে আমরা এতই পরিচিত যে পরবর্তী যুগে বাগদেবী রূপিণী সরস্বতীর সঙ্গে বৈদিক স্বরস্বতীর যে বিশেষ প্রভেদ আছে তা অনেক সময় বুঝতে পারিনা| 'নিঘন্টু'- নামে যে বৈদিক শব্দের সংকলন গ্রন্থ আমরা পাই তাতে দেখা যায় যে 'সরস্বতী'- শব্দটি 'বাক নাম' 'নদী নাম' ও 'দেবতা'-নামের মধ্যে পঠিত হয়েছে| তাই এই জ্যোতির্ময়ী দেবী সরস্বতী জ্ঞানের জ্যোতিতে অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করেন|
উপনিষদে বলা আছে বিদ্যার দ্বারাই অমৃতকে লাভ করা যায় |সেই বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী তিনি অমৃত অর্থে সরস + বতী - তিনি হলেন সরস্বতী| বিভিন্ন মন্ত্রে দেবী সরস্বতী বাক রূপিণী অথবা নদী রূপিণী রূপে স্তুত হয়েছেন| স্বরস্বতী নদীর রূপের কথাই আগে বলা যেতে পারে| ডঃ এম এল খান ও প্রমুখ গবেষকদের মতে, "The earliest notion of Saraswati Was undoubtedly as a river".
নদীটির নাম সরস্বতী। হিমালয় থেকে এর উৎপত্তি। ঋগ্বেদে এই নদীর সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। জনশ্রুতি আছে যে বৈদিক যুগের মানুষ এই নদীর তীরে বসবাসের সময়েই ঋগ্বেদ রচনা করেন। এই নদীর ওপর চেতনা আরোপ করেই বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবী সরস্বতীর কল্পনা করা হয়েছে। বেদশাস্ত্র সহ একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এমন অজস্র স্তোত্র রয়েছে, যাতে জীব জগতের প্রাণদায়িত্রী হিসেবে সরস্বতী নদীর কল্পনা করা হয়েছে। এই নদী ধর্মীয় আস্থার সঙ্গে এতটাই যুক্ত যে, পূজা প্রকরণের অঙ্গ হিসেবে মন্ত্র উচ্চারণে গঙ্গা,যমুনা,গোদাবরি, নর্মদা,সিন্ধু,কাবেরী – এই ৬টি নদীর সঙ্গে একযোগে সরস্বতী নদীর উল্লেখ করা হয়। এলাহাবাদের পবিত্র সঙ্গমে গঙ্গা ও যমুনার জলধারার সঙ্গে মিলিত তৃতীয় জলধারাকে অন্তঃসলিলা সরস্বতীর জলধারা রূপে কল্পনা করা হয়। লক্ষ্য করার বিষয়,পুরী ধামে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে ভোগ রান্নার জন্য জলের যে দুটি প্রবাহকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, রূপক হিসেবে সরস্বতী জলধারা রূপে তার একটির নামকরণ করা হয়েছে।
ফরাসী পন্ডিত মাইকেল দানিনো এবং ভারতের পুরাতত্ব সমীক্ষা বিভাগের প্রাক্তন মহানির্দেশক, ঋগবেদ যুগের সরস্বতীকে বর্তমানে হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত এবং সিরসার কাছে বিলুপ্ত হওয়া সরস্বতী-ঘাগরার মিলিত প্রবাহ রূপে চিহ্নিত করেছেন। প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ও প্রায় ২০০ বছর আগের ব্রিটিশদের তৈরি করা মানচিত্রে এই নদীকে ঘাঘর-হাকরা নদী রূপে উল্লেখ করা হয়েছে।ঘাঘর নামে এই নদীটি হরপ্পা সভ্যতার সময় প্রবাহিত হত |এর উল্লেখ ইন্দাস ভ্যালির ইতিহাসে পাওয়া যায় |
এই নদীর অস্তিত্বের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে শুরু থেকেই তীব্র বিতর্ক ও মতপার্থক্য রয়েছে। আর সে কারণেই একে ঘিরে কৌতুহল দিন দিন বাড়ছে। আসলে মতপার্থক্য যাই থাকুক না কেন, সেই ঋগবেদের যুগ থেকে নিয়ে আজ অবধি এই নদীর এতবার ,এত জায়গায় উল্লেখ আছে, তার অস্তিত্বকে কি করেই বা একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়! আসলে ভারতীয় জনমানসের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত যে এই নদী! (রচনাঃ- কৃষ্ণ ধন রায়)
খ্রি.পূর্ব তৃতীয়-চতুর্থ সহস্রাব্দে উত্তর-পশ্চিম ভারতে এক সুবিশাল তটিনী সরস্বতী। হিমালয়ের সিমুর পর্বতের প্লক্ষ প্রস্রবণ ছিল সরস্বতী নদীর উৎসস্থল। জলপ্রবাহ নির্মল স্বচ্ছ পবিত্র। নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠে বৈদিক সভ্যতার প্রধান প্রধান তীর্থক্ষেত্র। এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত বৈদিক সারস্বত যজ্ঞ। এই নদীর জলে পিতৃতর্পণ করা ছিল অতি পুণ্যের কর্ম। ঋকবেদে অবশ্য সরস্বান নামে এক নদীদেবতার কথা আছে। তারই স্ত্রীলিঙ্গ কি এই সরস্বতী? যিনি দেবীশ্রেষ্ঠা ও নদীশ্রেষ্ঠা রূপে স্তূত হয়েছেন - "অম্বিতমে নদিতমে দেবীতমে সরস্বতী।"
কাজেই বৈদিকসভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সরস্বতী নদী। দুই তীরে গড়ে উঠেছিল লতাকুঞ্জে ঘেরা সারস্বত তপোবন। ঋষিরা সেখানে বেদপাঠ করতেন। সূচনা ও সমাপ্তিতে করতেন সরস্বতী নদীর বন্দনা। রচনা করতেন বৈদিক সূক্ত। মহাজাগতিক ভাবরসে পুষ্ট মন্ত্রগাথা। কালক্রমে নদী হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। বেদের দেবী। একসময় অভিনয়ের দেবী হিসাবেও সরস্বতী পূজিত হতেন। বাৎসায়নের কামশাস্ত্র থেকে জানা যায় তৎকালীন রঙ্গমঞ্চের সাধারণ নাম ছিল সারস্বতভবন।
স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদী বিশীর্ণ হয়ে পরিণত হয়েছিল ক্ষীণতোয়া নদীতে| তরঙ্গ শালিনী সে নদীর শীর্ণতা বাড়তেই মানুষ অন্য নদীর মধ্যে সেই নদীর স্মৃতি খোঁজার চেষ্টা করছে| উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে আজও চলছে তার খোঁজ| ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাচীনতম প্রাণহারা সরস্বতী নদীকে খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসকে বারংবার বিতর্কিত করে তুলেছেন প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূ - তাত্ত্বিকেরা| ভূ-তাত্ত্বিকেরা বলেছেন রাজস্থানের দিদওয়ানা, জয়াল, নাগৌড়, পুস্করের বালিয়াড়িতে, লুনি নদীর অববাহিকায় মাটি খুঁড়ে এক প্রাচীন নদীর খোঁজ পাওয়া গেছে| সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং কার্যকারী উদাহরণ রয়েছে নাগর জেলায় একই জায়গায় স্তরে স্তরে|এর সময়কাল 24 হাজার বছর থেকে 28 হাজার বছর আগের|24 হাজার বছর আগে সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব ছিল |এই স্তর থেকেই বোঝা যায় এই স্তরে বালির চিহ্ন স্পষ্ট, জলে বসবাসকারী বিভিন্ন জীব যেমন কুমীর ও মাছের জীবাশ্ম রয়েছে |এই স্তরে বড় নদী এবং তার ধারে বিভিন্ন জীবের বসতির প্রমাণ অত্যন্ত স্পষ্ট|
ভূতাত্ত্বিক পাথরে প্রমাণ ছাড়াও আরও কিছু প্রমাণ রয়েছে| রাজস্থানের আজমীরের এর আশেপাশে যেসব ফুল জন্মায় তাদের পরাগরেণু বিশ্লেষণ করে জিনের উপর আবহাওয়ায় প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে |সেখান থেকে জানা গেছে 50 হাজার বছর আগে ওই অঞ্চলের জলবায়ু ছিল অত্যন্ত আদ্র| আবার 10 হাজার বছর আগে জলবায়ু শুষ্ক হয়ে ওঠে |5000 বছর থেকে 3000 বছর আগে পর্যন্ত মোটামুটি বৃষ্টিপাত হয়েছে |তারপর থেকেই চলছে শুষ্ক আবহাওয়া| কাজেই প্রশ্ন স্রোতস্বিনীর সক্রিয় কালের আরো হদিস পাওয়া গেল, আজ থেকে 10-12 হাজার বছর আগে অর্থাৎ অন্তত খ্রিস্টপূর্ব 8000 অব্দে সরস্বতী স্রোতস্বিনী নদী ছিল| উত্তর-পশ্চিম ভারতের বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে মরুভূমি তৈরি হওয়ার ঘটনা এবং আরও অনেক পরে মরুভূমির বয়স নির্ণয় করে দেখা গেছে যে তার বয়স মাত্র 3000 বছর |তবে আজ থেকে 5000 বছর আগে বৃষ্টিপাত কমে আসার পর মাটিতে জৈব দ্রব্য কমতে শুরু করেছিল |নদীর ধারা কিন্তু বহুদিন ধরে রাখতে পেরেছিল তার উদ্ভিদ জীবন কিন্তু যে নদী হিমালয়ের বরফ গলা জলে পুষ্ট, অনাবৃষ্টির কারণে শুকোবে না| হলে বড় মাপের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের একমাত্র ভূমিকম্পের কারণে সেটা সম্ভব|কিন্তু কোন পথে কিভাবে সরস্বতী নদী শুকিয়ে ছিল তারও কিছু তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন ঐতিহাসিক এবং ভূতাত্ত্বিকেরা|
আজ থেকে প্রায় 4000 বছর আগে যখন সরস্বতী নদী সিন্ধু নদের দিকে বেঁকতে শুরু করেছিল তখনই শুরু হয় স্বরস্বতীর বিশীর্ণতা|ভূতাত্ত্বিক ভাবে দেখলে দেখা যায় যেহেতু ইউরোপিয়ান টেকটোনিক প্লেট এবং ডেকান টেকটোনিক প্লেটের সংযোগ রেখা বরাবর সমান্তরালভাবে সিন্ধু ও সরস্বতী বয়ে চলত তাই একের সমৃদ্ধিতে অন্যের বিশীর্ণতা বৃদ্ধি পেল| ঐশ্বর্যময়ী হতে শুরু করল সিন্ধু ও তার শাখা-প্রশাখা গুলি| এই সময়ে 400 বছরে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প হওয়ার ফলে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে মোহনার কাম্বে উপসাগর স্বরস্বতীর বদ্বীপ তৈরীর কাজ সম্পূর্ণরূপে বিঘ্নিত হয় এবং শেষে বিঘ্নিত হয় এবং শেষে খাত বদল করে সরস্বতী নদী কচ্ছের রান অঞ্চলে প্রবেশ করে|
ঋক সংহিতায় মোট 45 বার সরস্বতী নদীর উল্লেখ রয়েছে যেখানে গঙ্গা নদীর উল্লেখ মাত্র দুবার এবং যমুনা নদীর উল্লেখ মাত্র তিন বার দেখা গেছে| এর থেকেই বোঝা যায় যে চার হাজার বছর আগে সে নদীর গুরুত্ব ছিল কতখানি! মনে হতেই পারে ভূ-তাত্ত্বিক কারনে এত পরিবর্তন ঘটেছে, মরুভূমির বালিতে ঢেকে গেছে পথ কিন্তু এখানেই ঘটেছে এক আশ্চর্য ঘটনা, সরস্বতী নদীর পুনরুজ্জীবনের প্রকল্প শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা গেল মৌসুমী বায়ু মাত্রাতিরিক্ত দাক্ষিণ্য দেখাতে শুরু করেছে উত্তর-পশ্চিম ভারতে|গত 2005 এবং 2006 সালে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয় রাজস্থানে এবং গুজরাটে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাব বৃদ্ধি পায়| গুজরাটেও বন্যা হয়| মৌসুমী বায়ুর এই খামখেয়ালীপনা পর্যালোচনা করে পুনার 'ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মিটি ওলজির'- বিজ্ঞানী ডঃ হর্সেসৱ পূর্বাভাস দিয়েছেন যে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের দাক্ষিণ্যে আবার সরস্বতী নদীর অববাহিকা হয়ে উঠতে চলেছে শস্য-শ্যামলা|
সরস্বতী নদী রূপটি বেশ প্রাচীন|বর্তমানে এই নদীর স্রোতধারা দেখা না গেলেও একদিন যে সেটি বেগবতী ছিল তা বেশ বোঝা যায়| সরস্বতী নদীর উল্লেখ বৈদিক সাহিত্যের বহুস্থানে আছে| বর্তমানে তাই সরস্বতীর দেবী রূপের পাশাপাশি নদীর রূপটিকে ও গুরুত্ব দিতে হয়| বেদে যে নদী গুলির উল্লেখ আছে সেগুলি শুধু দৈব নদী হিসেবেই নয় বরং বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির উৎস হিসাবেও ধরা হয় এবং প্রজাপতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত| পুরাণে প্রজাপতি ব্রহ্মার সঙ্গে যুক্ত এবং সরস্বতী 'বাক' -এর সঙ্গে যুক্ত
ব্রহ্মমানসে| ব্রহ্মাও সরস্বতীর স্রষ্টা|
সরস্বতীর একটি শক্তিশালী উৎস পাহাড়ে এবং অনেক দূরত্ব পার হয়ে সে সমুদ্রে মিলিত হয় |এই নদী কখনো অপরিষ্কার বা বদ্ধ হয়নি কারণ এই নদী প্রবাহমানা |তাই সরস্বতী চির সম্মৃদ্ধ এবং মানসিকভাবে যেন অনুপ্রেরণার উৎস| সরস্বতী নদীর জলরাশি স্বচ্ছ নির্মল| যার জলে অবগাহনাদির দ্বারা সারা শরীর ও মন শীতল এবং শুদ্ধ হয় |এছাড়া তিনি একজন পবিত্রা অথবা কৃষি সহায়ক| তথা নদীপথে বাণিজ্যের আনুকূল্য ধনদানকারিনী| নদী সরস্বতীর বর্ণনা দিয়ে ঋকবেদের আরম্ভ কিন্তু পরিসমাপ্তি ঘটেছে দেবী স্বরস্বতীর দৈবস্বরূপ অনুচিন্তনে |
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন