আমাদের হীরালাল সেন : চাষী সিরাজুল ইসলাম

আমাদের হীরালাল সেন : চাষী সিরাজুল ইসলাম
আমাদের হীরালাল সেন : চাষী সিরাজুল ইসলাম

( ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা )


আমাদের মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে  জন্মগ্রহণকারী হীরালাল সেনকে ভারতীয় উপমহাদেশর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে গণ্য করা হয়। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেই তিনি পরিচিত। প্রায় ৪০ টির মতো ছবি বানিয়েছেন। আনুমানিক উনিশ শতকের শেষ ভাগে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৯৮ সালে ফ্রান্সের লুই লুমিয়ের ও অগাষ্ট লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়েরর উদ্ভাসিত সিনেমাটোগ্রাফির মাধ্যমে  চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনীর যে বিকাশ ঘটে। তারই প্রতিফলন দেখা যায় ১৮৯৬ সালে বোম্বেতে। লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় ৭ জুলাই বোম্বের ওয়াটসন হোটেলে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর শুরু করেন। একই বছর নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতায়ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয়। 

১৯৯৮ সাল থেকে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করেন দুইভাই হীরালাল ও মতিলাল সেনও। এই সময়ে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন বিখ্যাত ফরাসী দুই ভাই 'পাতে ব্রাদার্স'। তাঁরা সিনেমার যন্ত্রপাতি বিক্রি এবং ভাড়ার ব্যবসা করতেন। এই দুইভাই ভারতে এলে তাদের সংগে হীরালাল সেনের যোগাযোগ হয়। তাঁদের থেকে একটি ক্যামেরা ভাড়া নিয়ে হীরালাল নিজেই কলকাতার বিভিন্ন জায়গার শুটিং শুরু করেন। ছোট ছোট দৃশ্যায়ণে  চিৎপুরের চলমান দৃশ্য, মানিক গঞ্জের নিজ-গ্রাম বগজুরির বিবাহোৎসব দৃশ্য, বগজুরির স্নানার্থীদের দৃশ্য, শিবচরণ লাহার বাড়ির বিয়ে, দুলিচাঁদ মল্লিকের বাড়ির বিয়ের দৃশ্য, রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রভৃতি ছবি তোলেন সেলুলয়েডে। এইভাবেই তাঁর চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ ঘটে।

তাঁকে বাংলা চলচ্চিত্রর জনক বলা হয় এই কারণে, ১৯১৯ সালের ৮ নভেম্বর 'বিশ্ব-মঙ্গল' দিয়ে নির্বাক বাংলা ছবি যাত্রা শুরু করে। তার আগে ১৯১৪ সালে উপমহাদেশের প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র দাদা ফালকের 'রাজা হরিশচন্দ্র' মুক্তি পায়। আর হীরালাল সেন ১৯১৯ সালে 'বিশ্ব-মঙ্গল'-এর  আগেই ছোট ছোট ছবি বানিয়ে ফেলেছেন। জানা যায় প্রফেসর স্টিভেনসন নির্মিত 'দ্য ফ্লাওয়ার অফ পার্শিয়া' ছবিটি কলকাতার স্টার থিয়েটারে একটি প্রোজেক্টরের মাধ্যমে দেখানো হয়েছিল।ছবিটির কিছু কিছু অংশ তিনি হলের ভেতরে তার ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন। এই সিনেমাটি দেখেই এই মাধ্যমটির প্রতি তার ভালোবাসা জন্মায়।

হীরা লাল সেনের জন্ম ১৮৬৬ সালের আগস্ট মাসে। বড় হন কলকাতায়। তারা ছিলেন জমিদার। বাবা চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন নাম করা উকিল। মা বিধুমুখীর তিনি ছিলেন বড় সন্তান। তাঁরা ছিলেন অাট ভাইবোন। হীরালাল সেন মানিকগঞ্জ পাইলট স্কুল থেকে মাইনর পাশ করেন। মৌলভী সাহেবের কাছ থেকে ফার্সি ও শেখেন। এরপর ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। তারপর বাবার সংগে কলকাতা চলে যান। তাঁর বিয়ে হয় হিমাঙ্গী দেবীর সংগে। তিন সন্তানের জনক ছিলেন তিনি। বাবার পেশা মনে ধরেনি। দুই ভাই-ই ছিলেন সিনেমা পাগল। ১৮৮৬ সালে তিনি যখন আই এস সির ছাত্র তখনি স্টার থিয়েটারে প্রথম সিনেমা দেখেন এবং মাথায় ফিল্ম ঢুকে যায়। 

তখন থেকেই তিনি এব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠেন। সে সময়েই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ফাদার লাঁফো প্রোজেক্টর মেশিন এনে বিদেশী সিনেমা দেখাতে শুরু করে দিয়েছেন। ফাদার লাঁফোর কাছ থেকে প্রোজেক্টর মেশিনের খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে ছবি প্রদর্শণীর ব্যবসার কথা ভাবেন হীরালাল এবং মতিলাল। ১৮৯৮ সাল নাগাদ ফ্রান্সের লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের মতো চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু করেন হীরালাল ভাতৃদ্বয়। ঐ বছরের ৪ এপ্রিল কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে প্রথম বাঙালি প্রদর্শক  হিসেবে চলচ্চিত্রের প্রদর্শণ করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন হীরালাল সেন। ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে তিনিই প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শণ করেন।  ১৯০০ সালে বিদেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেন এবং ভাই মতিলালকে নিয়ে গড়ে তোলেন Royal Bioscope Company.

১৯০১ সাল থেকে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। ১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ৪০ টির মতো স্বল্প দৈর্ঘ চলচ্চিত্র বানান। হীরালাল ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ হওয়া নাটকগুলো থেকে দৃশ্য শুট করে নাটকের বিরতিতে দেখাতেন। তিনি অমর দত্ত, গিরীশ ঘোষ, অমৃতলাল বসুর মঞ্চস্থ নাটক গুলো ধারণ করতেন। ১৯০১ সাল থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত তিনি নির্মাণ করেন ভ্রমর, হরিরাজ, বুদ্ধদেব, আলীবাবা প্রভৃতি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। হীরালাল সংবাদ চিত্রও তৈরি করেছিলেন সেই সময়ে। ১৯০৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতা টাউন হলের অনুষ্ঠিত সভার ছবি তোলেন। সেই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শোভাযাত্রাও হয়েছিল। এই ছবির বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন, আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী ছবি। 

সেই প্রতিবাদ সভার-শোভাযাত্রার ছবি তুলে  তিনি প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।  ভারতের প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাতাও তিনি।  তিনি সি কে সেনের জবাকুসুম তেল, এডওয়ার্ড টনিক এবং সালসাপিলের  বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিলেন। তিনি ১৯০৩ সালে 'অলীবাবা ও চল্লিশ চোর' নামে একটি বড় দৈর্ঘ্যের ছবি বানান। যদিও ছবিটি কখনো প্রদর্শিত হয়নি। শোনা যায় ম্যাডান এর কর্ণধার জামশেদ রুস্তমজী এবং ইলেক্ট্রনিক বায়স্কোপ এর প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায় সিনেমা সংক্রান্ত অনেক টেকনিক্যাল কাজ ও পরামর্শ হীরালালের কাছ থেকে নিতেন। 'দুর্গেশনন্দিনী' ছবিটি নির্মাণের কাজেও তিনি সহযোগিতা করেছিলেন।

এক সময় ভাইয়ের সংগে তাঁর ব্যবসা আলাদা হয়ে যায়। হীরালাল সেন মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। চরম অর্থ সংকটে পড়ে ক্যামেরা এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি বিক্রি করে দেন। এরপর পর-ই হীরালাল সেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। সেই সময় এক অগ্নিকান্ডে তাঁর সমস্ত ছবির প্রিন্ট, বহু স্থির-চিত্র এবং নথি-পত্র পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হীরালাল সেনের মেয়ে অমিয়বালা দেবীও ঐ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুবরণ করেন। মুছে যায় হীরালাল সেনের সমস্ত কীর্তি। ১৯১৭ সালের ২৬ শে অক্টোবর কলকাতায় হীরালাল সেন দেহত্যাগ করেন। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের গর্ব হীরালাল সেন এ দেশেরই সন্তান এবং চলচ্চিত্রের মতো অাধুনিক শক্তিশালী এই শিল্প ও গণমাধ্যমটির পথিকৃত।

উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের পথিকৃত চলচ্চিত্রকার  হীরালাল সেনের ৩০টির অধিক ছবির একটি তালিকা পাওয়া গিয়েছে । সেটি নিচে দেয়া
হলো :

(1913)--Hindu Bathing Festival at Allahabad
(1913)--Arrival at Howrah.
(1912)--Grand Delhi Coronation Durbar and Royal Visit to Calcutta Including Their Majesties' Arrival.
(1912)--Princep's Ghat.
(1912)--Procession.
(1912)--Visit to Bombay and Exhibition.
(1912)--Tilak Bathing at the Ganges
(1906)--C. K. Sen's Jaba Kusum Oil (Documentary short)
(1905)--Edward's Anti-Malarial Specific.Short
(1905)--Sarsaparilla.Short
(1905)--The Bengal Partition Film.Short
(1905)--The Bengali Fisherman.Short
(1904)--The Fisherman's Boy
(1904)--Alibaba and the Forty Thieves.Short
(1903)--Coronation Ceremony and Durbar
(1903)--Indian Life and Scenes.Short
(1903)-- Scenes from 'Maner Matan' (Documentary short)
(1903)--Scenes from 'Sonar Swapan. Short
(1903)--Dances from Alibaba.
(1903)--Scenes from 'Alibaba'.Short
(1901)--Scenes from 'Bhramar'.Short
(1901)--Scenes from 'Buddhadev'.Short
(1901)--Scenes from 'Dol Leela'.Short
(1901)--Scenes from 'Hariraj' (Documentary short)
(1901)--Scenes from 'Sarala' (Documentary short )
(1901)--Scenes from 'Seetaram' (Documentary short)
(1901)--Scenes from the Plays Vramar, Alibaba, Hariraj, Dole Laila, Budda, Sitaram.
(1899)--Moving Pictures of Natural Scenes and Religious Rituals (Documentary short)
(1898)--Dancing Scenes from 'The Flower of Persia'Short (Co-director)


তথ্যঋণ:
১. অভিষেক ঘোষের শর্ট ফিল্ম: ইন্ডিয়াস ফাস্ট মুভি মেকার
২. আনন্দলোক, ৪৩ বর্ষ ৭ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল ২০১৭
৩.সৌমিক হাসান এবং
৪.ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.