মৃদুল শ্রীমানী
বিড়াল বলিল, মেঁও।
বলিলাম, কি, দুগ্ধ খাইতে সাধ হইয়াছে?
বিড়াল শ্রাগ করিয়া বলিল, দুগ্ধ যাহাকে বলে, তাহা তুমি ইদানিং চোখে দেখিতে পাও না। সুতরাং দুগ্ধের জন্য অকারণ চিন্তিত হইও না।
বলিলাম, কেন, প্রসন্ন গোয়ালিনী রিটায়ার করিয়াছে বলিয়া কি দুগ্ধ সংগ্রহ বন্ধ হইয়া গিয়াছে ভাবিয়াছ?
বিড়াল বলিল, আর হাসাইও না। তোমাদের গণতন্ত্রের বিশুদ্ধতা দেখিয়া বিশ্বসুদ্ধ লোকে হাসিতেছে।
বিরক্ত হইয়া কহিলাম, আমাদের গণতন্ত্রে বিশুদ্ধতার ঘাটতি কোথায় দেখিলে?
বিড়াল বলিল, সমুদ্রের তীরে প্লাস্টিকের জঞ্জাল কুড়ানো তোমাকে মানায় না।
রাগিয়া কহিলাম, কেন মানাইবে না, প্লাস্টিকের বোঝা কিছু কম ছিল না। খুব পরিশ্রম করিয়াছি।
বিড়াল বলিল, শুন, বৃহত্তম গণতন্ত্রে নরেন্দ্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে। উহা ফেলিয়া সমুদ্র তীরে প্লাস্টিক কুড়ানো, না না, এ তোমার কাঁচা বুদ্ধির নজির হইল।
বলিলাম, তুমি জানো, প্লাস্টিক দুনিয়া জুড়িয়া কী ভয়াবহ বিপর্যয় নামাইয়া আনিয়াছে?
বিড়াল ফ্যাঁচ করিয়া হাসিয়া কহিল, তাহার আগে বলো, তুমি প্লাস্টিক কুড়ানো খেলিবে বলিয়া জঞ্জালগুলি কতবার ধোওয়া হইয়াছিল?
চিৎকার করিয়া বলিলাম, তো আমি যাহা স্পর্শ করিব, তাহা বারে বারে দফায় দফায় স্যানিটাইজ করার জন্য বিশেষ বাহিনী রহিয়াছে।
বিড়াল বলিল, মেঁও। ওইখানেই তো উজবুকের মতো ধরা পড়িলে। জঞ্জাল স্যানিটাইজ করিতে যত মজুর নিয়োগ করিয়াছ, তাহার অপেক্ষা অনেক কম হাঙ্গামে জঞ্জাল সাফাই হইতে পারিত।
বলিলাম, কিভাবে বলো দেখি?
বিড়াল বলিল, যদি ঘোষণা করিতে এক কিলো প্লাস্টিক কুড়াইয়া আনিলে একটি করিয়া বাসি রুটি দিয়া সম্মানিত করা হইবে, তাহা হইলে তোমার আধপেটা খাওয়া, আধ ন্যাংটা জনগণ পড়িমড়ি করিয়া কিলো কিলো প্লাস্টিক কুড়াইয়া দিত। কয়েকটি পচা রুটিতে যে কাজ উৎরাইতে পারিত তুমি তাহা করিতে বিস্তর অর্থব্যয় করিলে।
বলিলাম, জনপ্রশাসন সম্বন্ধে তুমি কিছু বুঝ না। খামখা জ্ঞান দিওনা বলিতেছি।
বিড়াল বলিল, তওবা তওবা, কি আমার বিজ্ঞ শাসক আসিলেন! বলি, চন্দ্রযানটি গোমূত্র ও গোময় লিপ্ত করিতে গিয়া প্রকল্পটির বারোটা বাজাইয়াছ, তাহা জান?
বলিলাম, গোময় ও গোমূত্র বস্তু হিসাবে কত উৎকৃষ্ট, তাহা তুমি জান?
বিড়াল একগাল হাসিয়া কহিল, তোমার শাসনে ওই দুটি বস্তু অতি বিশুদ্ধ মাত্রায় মিলিতেছে। কিন্তু দুগ্ধের বিশুদ্ধতা নিয়ে তুমি বাগবিস্তার করিও না। কেহ কখনও শুনিয়াছে, চা ওয়ালা বিশুদ্ধ দুগ্ধের কারবার করে?
আমার আঁতে বড়োই লাগিল। স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপের তলব করিলাম। মুখের কথা খসিবার আগেই হতভাগা বিড়াল পলাইল।
আমি একদলা অহিফেন ঠুসিয়া প্রসন্ন গোয়ালিনীর স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম।
কিছুক্ষণ পরে বিড়াল বলিল, আমাদের দেশে আদালত একটি সার্কাস মাত্র। বড়লোকে পয়সা খরচ করিয়া তাহা দেখে।
আমি বলিলাম, তেমনটি তোমাদের মার্জার রাজ্যে হইতে পারে। কিন্তু, আমাদের রামরাজ্যে সমস্ত আদালতে আগাপাস্তলা সুবিচার।
বিড়াল বলিল, তোমাদিগের সংসদীয় রীতি নীতি?
সে উকিলবাবুটি বলিয়াছিলেন বটে। দলের কর্তাকে বলেছিলেন, শুনহ, আমি এখন দেশের হইয়া স্পীক করিব। আমি যে এখন দেশের সংসদের স্পীকার। এখন তো দলের হইয়া স্পীক করিতে পারিব না। দলের গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ছকে মিউ মিউ করা কি সংসদের স্পীকারের সাজে? এখন আমার তানপুরা সংসদীয় গণতন্ত্রের ঘরানায় ম্যাওঁ ম্যাওঁ করবে।
নেতা তো রাগিয়া কাঁই। তিনি স্পষ্ট বলিলেন, আরে লোকের সামনে গণতন্ত্রের কথাই তো বলিতে হইবে। সেটাই নিয়ম। আর লোক চক্ষুর আড়ালে, দলের ভিতর কেন্দ্রিকতার নিয়ম। দুয়ে মিলে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা।
উকিলবাবু ছোড়নেবালা নেহি। সাফ বলিলেন, দল ছাড়ুঙ্গা, লেকিন বাক স্বাধীনতা নেহি ছাড়ুঙ্গা । সর্ব বৃহৎ গণতন্ত্রের সংসদের স্পীকার। এমন একটা কীর্তি করিব যে লোকে ভুলিতে পারিবে না। হ্যাঁ নেতাবাবু, তুমিও ভুলিতে পারবে না।
বিড়াল বলিল, সে সব তোমাদিগের আমলের বিপক্ষ নেতাকে ঝাপ্পি দিয়া ফিরিয়া আসিয়া মুহূর্তে তৃতীয় শ্রেণীর ফিল্মের নটীকে নকল করে চোখ টেপা গণতন্ত্র নহে।
বিড়ালকে বলিলাম, "রাজধর্ম বলিতে কি বুঝ?"
আমার দিকে তাকাইয়া ফ্যাচ করিয়া হাসিয়া সে কহিল "দুধ এবং মাছের যোগানে ঘাটতি না থাকিলে, আর জলযোগে কাবাব ও চিংড়ি চপের পর্যাপ্ত যোগান থাকিলে, চক্ষুদ্বয় আরামে অর্ধ নিমীলিত করিয়া কবিতা আওড়াইব। ইহাকেই রাজধর্ম পালন বলিতে পারো।"
এই বিড়ালটি আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। ভূষণ্ডী কাকের মতোই বহুদর্শী ভূয়োদর্শী এই বিড়াল। সত্যযুগে এঁর সাথে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের মোলাকাৎ হইয়াছিল। সে কথা তিনি "কমলাকান্তের দপ্তর" নামে সুখপাঠ্য রচনায় পেশ করিয়াছেন। পরিত্রাণাং সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাং এই মার্জার কুলতিলক আবির্ভূত হইয়া থাকেন।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন
(
Atom
)
0 Comments:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন