মাঝ পথে ছেড়ে গেল : শামিমা এহেসানা

শামিমা এহেসানা
  গল্পের নাম- মাঝ পথে ছেড়ে গেল
(বিষয় - এমএসসি পাশ মেয়ের বিএ পাশ ছেলের সাথে বিয়ে না করতে চাওয়া আর তার পর এক অমোঘ ভালোবাসা তবুও কপাল পোড়ার গল্প)


ঘড়িতে সময়, রাত্রি ২.৪৫। দশ বছরের মেয়ে 'সালাহ' আর আট বছরের ছেলে মৃদুল হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মৃদুল ঘুমানোর সময় বিড় বিড় করে ওঠে মাঝে মাঝে। কি সব হিজিবিজি বলে। একদিন বলেছে, "স্পাইডার ম্যান, আম কামিং।" ডাক্তার বলেছে এই নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেয়। সারাদিন মা কে কাছে না পেয়ে কার্টুন,  টিভি, আর রিমোট নিয়েই মৃদুলের দিন কাটে। বিকেলে দিদি স্কুল থেকে ফিরলে খেলা কম আর মারপিট বেশি করে সে।

টেবিল ল্যাম্প এর সামনে বিয়ের এলব্যামটা খুলে এই সব ভাবছিলেন সুকন্যা। মেয়েটা এক্কেবারে বাপের চেহারা পেয়েছে, আর স্বভাব ও তাই। কিন্তু ছেলে মৃদুল বাবার মত চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই পায়নি। যেমন দুষ্টু তেমন মারকুটে। আর হবে নাইবা কেন? এইটুকু একটা শিশু না পেয়েছে বাবার সান্নিধ্য না পায় মাকে। কি বা আশা করা যায় এমন হতভাগ্য শিশুটার কাছ থেকে। মা, সুকন্যা সকালে মৃদুলকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিয়ে, রান্না করে স্কুলের জন্য বেরিয়ে যায়। তিন ঘন্টা যেতে আর তিন ঘন্টা আসতে।  চাকরি ছাড়ার প্রশ্নই নেয়। বরং ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় সুকন্যা। দু বছর আগে প্যারা টিচার এর নিয়োগের সময় এই চাকরিটা পেয়েছিল সুকন্যা।

সব কিছু কত তাড়াতাড়ি বদলে যায়। ভাগ্যের বদল মানা যায়, কিন্তু মানুষের মনের বদল মেনে নিতে কষ্ঠ হয় সুকন্যার।

শান্ত স্বভাবের সুকন্যা বাবা মার সব ইচ্ছা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। নিজের পছন্দ কখনও জাহির করেনি। সুকন্যার গ্রামে মেয়েরা মাধ্যমিক পাশ করলে পাশের বাড়ি ঠাম্মারা চিন্তায় পড়ে যায়। বলে, মেয়েরা বেশি পড়লে অল্প বয়সে বিধবা হয়। সুকন্যা হাসে এসব শুনে। ভাবে, যদি বদলে ফেলতে পারতো এই গ্রাম সহ আরও বহু গ্রাম, যেখানে মেয়েদের শিক্ষাকে এখনও গুরুত্ব দেওয়া হয়না।

সুকন্যা এমএসসি করার সময় ভেবেছিল, এমন একটা ছেলেকে বিয়ে করবে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ওর থেকে বেশি হবে। মেয়ের ইচ্ছার অমর্যদা ওর বাবাও করেনি। যথাসাধ্য চেষ্ঠা করে পাত্র খুঁজেছিল সুকন্যার জন্য। কিন্তু সুকন্যার বাইরের দেশে বা দূরে কোথাও অন্য কোনো শহরে, এমনকি কলকাতাতেও সে  বিয়ে করবেনা জেদের জন্য অনেক শিক্ষিত ছেলে হাত ছাড়া হয়েছে।

কলকাতা শহরের চাকচিক্য, লিফট, পার্কস্ট্রিট, ক্যাথিড্রাল সবই ভালো লাগে সুকন্যার। কিন্তু বাবা মার থেকে অতটা দূরে গিয়ে সংসার করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অনেক পাত্র দেখার পর সুদর্শন কে পছন্দ করেছে সুকন্যার বাবা।

সুদর্শন এর নামটা যে রেখেছিল, সে সত্যিই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিল বলতে হয়। যেমন সুন্দর চেহারা তেমনি গড়ন। দ্রখে সুকন্যার পছন্দ হবে সেটা বাবা বুঝেছিলেন। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে মেয়ে প্রশ্ন তুলবেই, তার উপর প্রফেশনটাও মেয়ের পছন্দ হবেনা। তবুও সুকন্যার সামনে প্রস্তাব রেখেছিল বাবা।

ছেলে বিএ পাশ, নিজের ব্যাবসা আছে ইলেক্ট্রনিক গুডস এর, এসব শোনার পর কিছুদিন চুপ ছিল সুকন্যা। তারপর মা এর শরীরের অবস্থা ভেবে বিয়েতে রাজি হয় সে।

বিয়ের দিন প্রচুর কেঁদেছিল সুকন্যা। কেও বুঝতে পারেনি, এ কান্না শুধু তার বাপের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার নয়, বরং স্বপ্ন ভংগের কান্না ছিল। সুকন্যা ভেবে উঠতে পারেনি বিয়ের আগের তিন মাসে, সে কি নিয়ে আলোচনা করবে সুদর্শন এর সাথে, তাদের বিয়ের পর। ডারউইন, জিন থিয়োরী, নাকি আইনস্টাইন?

কিন্তু এই সব ভাবনা কর্পুররের মত উবে গেছিল বিয়ের প্রথম সপ্তাহে। সুদর্শন অদ্ভুত ভালো মানুষ। বরকে সামনে দেখে সুকন্যা ভুলে যায় পুরোনো স্বপ্ন, খারাপ লাগা, ভাবনা, সব কিছুই। মাথা ঝুঁকে যায় তার, সুদর্শনের সামনে। বা আরও সহজ করে বললে বাড়ির নিচের ইলেক্ট্রিক গুডস এর দোকান খোলার সিদ্ধান্তটার জন্য সুদর্শনকে ধন্যবাদ জানায় সুকন্যা। এই যে কাস্টমার এর চোখে ধুলো দিয়ে দিনে দশবার সুবোধ বরটি তার বৌ কে বিভিন্ন বাহানায় দেখতে আসে।

ওদের দুজনের একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ভগবান আর ভক্তের মতই। সে বিশ্বাসে ছেদ পড়েনি কোনো পরিস্থিতিতে। কিন্তু শেষটা এত খারাপ হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি সুকন্যা। সুদর্শন কথা রাখেনি।

আজ থেকে ঠিক একবছর আগে এই দিনেই সুকন্যার সব বিশ্বাস ভেংগে টুকরো হয়েছে। সেদিন শুক্রবার ছিল। কলকাতায় এক মহজনের সাথে দেখা করার নামে বেরিয়েছিল সুদর্শন। তার মনে কি ছিল, সেকথা সুকন্যা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।

রাত তখন ১২ টা। সুদর্শন ফোন করে বলেছিল, আর মাত্র আধ ঘন্টায় সে বাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু কথা রাখেনি। ঘন্টা দুই অপেক্ষা করে ছটফট করতে করতে ফোন করেছিল সুকন্যা। ফোনের ওপারে এক অপরিচিত কন্ঠ বদলে দিল সুকন্যার জীবন।

একটা মালবোঝাই লরি পিছন থেকে ধাক্কা মারে সুদর্শনের  অলটো গাড়িটাতে। লরির ড্রাইভার পালিয়ে গেলেও স্থানীয় লোকজন সুদর্শনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু তার মাথার চোট এতটাই গভীর ছিল যে হাসপাতালে নেবার আগেই সে তার স্বপ্নের সংসার ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ এসে সুদর্শনের গাড়ি থেকে একটা এনভেলপ পায়। যার মধ্যে চারটে টিকিট রাখা ছিল। রবিবার সুকন্যার জন্মদিনে তাকে সিমলা নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল সুদর্শন। তাই মিথ্যা করে মহজনের নাম নিয়ে বেরিয়েছিল সে।

আজ একটা বছর পার। সবকিছু বদলে গেছে। কাছের মানুষজন মুখ ঘুরিয়েছে। দোকানটাও বন্ধ। ভরসা বলতে এই চাকরিটাই। মেয়েটা তবু সামলে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু মৃদুল এতটাই ছোটো যে তাকে রিমোট গাড়ি কিনে না দেওয়ার কারন সুকন্যা বলতে পারেনা।
স্কুল থেকে ফেরার সময় অন্যান্য বাচ্চাদের বাবার সাথে ফিরতে দেখে মৃদুল মা কে জিজ্ঞাসা করেছে বাবা কবে ফিরবে? সুকন্যা উত্তর দেয়নি। সময় মৃদুলকেও সব শিখিয়ে দেবে। যেভাবে শিখেছে সুকন্যা নিজেও।

টপ করে এক ফোঁটা জল পড়লো এলবামে। সুদর্শন এর ছবিটা আরও বেশি চকচকে লাগে সুকন্যার ঝাপসা চোখে। সাদা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সুকন্যা ভাবে, গ্রামের ঠাম্মাই কি ঠিক বলেছিল? বেশি পড়লে বিধবা হতে হয়? ভালোবাসার কাছে কখনও কখনও যুক্তিও হার মানে বোধ হয়।
Share on Google Plus

About Shraboni Parbat

This is a short description in the author block about the author. You edit it by entering text in the "Biographical Info" field in the user admin panel.